Wednesday 01 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাম্প্রদায়িকতার ‘কৃত্রিম উত্থান‘ ঘটছে— জন্মদিনে অনুপম সেন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৫ আগস্ট ২০২২ ১৫:১৮ | আপডেট: ৫ আগস্ট ২০২২ ১৭:১৯

অনুপম সেন, ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ৮২ বছর পূর্ণ করেছেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। তারুণ্যে যে মানুষটি মানবিক সমাজ গড়ার দীক্ষা নিয়েছিলেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও সেই মন্ত্রেই এখনো উজ্জীবিত তিনি। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, নাগরিক আন্দোলনেও থাকেন সামনের কাতারে। অনুপম সেন মানেই যেন লড়াই-সংগ্রামের ‍মুষ্ঠিবদ্ধ হাত।

যৌবনে ভালোবেসে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন অনুপম সেন। এই শিক্ষকতা করতে গিয়েই পাকিস্তান আমল থেকে সকল গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, মানবিক সমাজ গড়ার আন্দোলনে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে দেশে যেমন পেয়েছেন অকুণ্ঠ সম্মান, বিশ্বসভায়ও সম্মানিত হয়েছেন। শিক্ষায় পেয়েছেন একুশে পদক।

বিজ্ঞাপন

বার্ধক্যে উপনীত হয়েও ছাড়েননি শিক্ষকতা পেশা। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশটাকে ভালোবাসেন হৃদয় উজাড় করে। দেশের যে কোনো সংকট তার হৃদয়ে দাগ কাটে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া দেশটিতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান দেখে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। শুক্রবার (৫ আগস্ট) ৮৩ তম জন্মদিনে দেশ এবং বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপ করেছেন অনুপম সেন।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িকতার যে উত্থান সেটা একেবারেই কৃত্রিম বলে মনে করছেন তিনি। অনুপম সেন বলেন, ‘মানুষ যখন বিপন্ন বোধ করে তখন ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িকতা আমরা দেখছি সেটা একেবারেই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এই সংকট নতুন নয়। বৃটিশ আমলে আমরা দেখেছি, পাকিস্তান আমলেও দেখেছি। এমনকি বৃটিশরা আসার আগেও ছোটখাট ঘটনা ছিল। এই ঢেউ কোনোসময় বাড়ে, কোনোসময় কমে। এগুলো সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। অশিক্ষা-কুশিক্ষার ওপরও নির্ভর করে।’

বিজ্ঞাপন

বিশ্বজুড়েই সাম্প্রদায়িকতাকে এই মুহুর্তে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানের উত্থান ঘটাল আমেরিকা। এরপর থেকেই একটা অস্থিরতা কিন্তু পুরো বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হল। এমনকি আমেরিকাও আক্রান্ত হল একসময়। ধর্মান্ধতার উত্থান হল। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে এখন ধর্মান্ধতার যে সংকট এর পেছনেও আছে রাজনীতি। কিন্তু অনেক সময় সেটা বুমেরাং হয়ে ফেরত আসে। যেমন- এখন বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ধর্মান্ধতা বুমেরাং হয়ে দেখা দিচ্ছে।’

তবে এর চেয়েও বড় সংকট হয়ে দেখা দিতে পারে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এমন আশঙ্কা অনুপম সেনের। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে তো দুই বছর বিশ্ব একেবারে স্থবির ছিল। এশিয়ায় তাও কৃষিকাজটা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে তো কৃষিকাজও বন্ধ ছিল। ফলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে গেল। খাদ্যঘাটতির একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সময় যখন আসল, তখন শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ২০০৮-০৯ সালের বিশ্বমন্দার পর আরেক দফা স্থবিরতা তৈরি হল।’

তবে বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্যঘাটতি কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়বে না, এমন বিশ্লেষণ এই সমাজবিজ্ঞানীর। অনুপম সেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। কিন্তু এখন শিল্প, কৃষি ও সেবাখাত তিনটাই এগিয়ে গেছে। শিল্পায়নের কারণে গত এক দশকে প্রবৃদ্ধি প্রচুর হয়েছে। যদিও শিল্পায়নটা মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর, কিন্তু অন্যান্য খাতও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমাদের দেশ তো এখন সিরামিক পণ্য, ওষুধও রফতানি করে।’

তৈরি পোশাক খাত সংকটে পড়ার সম্ভাবনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় এখন মন্দা শুরু হয়েছে। চীনে রফতানি কমে যাচ্ছে। ইউরোপেও যদি মন্দা শুরু হয়, তাহলে আমাদের পোশাক রফতানি কমে যাবে। এরপরও বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলংকার মতো হবে- এমন ভাবার কারণ নেই। দেড়-দুই বছর কিছুটা সংকট থাকলেও এরপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’

সংকট কাটাতে কয়েকটি মেগাপ্রকল্পের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। অনুপম সেন বলেন, ‘ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইনের যে প্রকল্প সেটার কাজ আপাতত বন্ধ রাখলে আমাদের অর্থনীতিতে এমন কোনো প্রভাব পড়বে না। মীরসরাই ইকোনমিক জোনের কাজও ধীরেসুস্থে করা যাবে। বিশ্বজুড়ে মন্দা চলছে, এখন তো বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কম। ১০০টা ইপিজেড করার যে প্রকল্প সেটাও আপাতত বন্ধ রাখা উচিৎ।’

তবে খাদ্যঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন দেশে প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ যে শুধু ধান উৎপাদন করে তা’ই নয়, মাছ, মুরগি, সবজিতেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গমের সংকট হতে পারে, কিন্তু গম তো আমাদের খাদ্য নয়। তাই এটা অন্তত বলতে পারি যে, দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে কেউ মারা যাবে না। এরপরও সংকট কিছুটা হবে, তবে আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোতে যে পরিমাণ সংকট হচ্ছে সেটা নাও হতে পারে।’

কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ঘাটতি দ্রুত সামাল দেওয়ায় দেশ শিল্পায়নে এগিয়ে গেছে বলে মনে করছেন অনুপম সেন। বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি।

শিক্ষাখাতেও দেশ গত এক দশকে এগোলেও মানের ব্যাপারে আরও জোর দেওয়া উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। অনুপম সেন বলেন, ‘পণ্ডিত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, মান যা-ই হোক, বিদ্যাটা যেন পায়। চিঠি পড়ার জন্য যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এক মাইল যেতে না হয়। এখন আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার সার্বিক মান ভালো নয়। তবে প্রতিভার বিকাশ হচ্ছে। এক দশকে প্রতিভাবান অনেক শিক্ষার্থী বের হয়েছে।’

১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে অনুপম সেনের জন্ম। বাবা বীরেন্দ্রলাল সেন ও মা স্নেহলতা সেন। বাড়ি পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে। চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে সমাজতত্ত্বে স্নাতক ডিগ্রি নেন অনুপম সেন। ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট) সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন।

১৯৬৬ সালে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সহায়ক ও টিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে পুনরায় যোগদান করেন।

প্রফেসর সেন ‘দ্য স্টেট, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ক্লাশ ফরমেশন ইন ইন্ডিয়া’ ছাড়াও অনেক বইয়ের রচিয়তা। এক্ষেত্রে তার দ্য পলিটিক্যাল এলিটস অব পাকিস্তান অ্যান্ড আদার সোশিওলজিক্যাল এসেস (১৯৮২, অমর প্রকাশন, দিল্লি), বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ, সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ (১৯৮৮), বাংলাদেশ ও বাঙালি রেনেসাঁস: স্বাধীনতা চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান (২০০২), বিলসিত শব্দগুচ্ছ (২০০২), ব্যক্তি ও রাষ্ট্র: সমাজ-বিন্যাস ও সমাজ-দর্শনের আলোকে (২০০৭), কবি শশাঙ্কমোহন সেন (২০০৭), সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য: নানা কথা, নানা ভাবনা, নানা অর্ঘ্য (২০০৭), সুন্দরের বিচার সভাতে (২০০৮), আদি-অন্ত বাঙালি, বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ (২০১১), বাংলাদেশ: ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন (২০১১), জীবনের পথে প্রান্তরে (২০১১), বাঙালি-মনন, বাঙালি সংস্কৃতি, সাতটি বক্তৃতা (২০১৪), ইতিহাসে অবিনশ্বর (২০১৬) ও বিচিত ভাবনা (২০১৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার ‘দ্য স্টেট, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ক্লাশ ফরমেশন ইন ইন্ডিয়া’ ১৯৮২ সালে প্রকাশের প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে রাউটলেজ আবার প্রকাশ করেছে ২০১৭ সালে, ‘রাউটলেজ লাইব্রেরি এডিশন: ব্রিটিশ ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে।

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

অধ্যাপক ড. অনুপম সেন অনুপম সেন টপ নিউজ ড. অনুপম সেন

বিজ্ঞাপন

ফিরে দেখা ২০২৪ / ছবিতে বছর ভ্রমণ
১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪৫

আরো

সম্পর্কিত খবর