মরিশাসের ইন্টারনেটে ভারতের গোপন নজরদারি
২৬ জুলাই ২০২২ ২২:৪৭ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২২ ০০:১৪
ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জুগানাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, একটি আন্তর্জাতিক সাবমেরিন কেবল প্রকল্পে তিনি বেআইনিভাবে ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের একটি ‘স্নিফিং ডিভাইস’ বা গোপনে নজরদারি চালানোর যন্ত্র বসানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
এ অভিযোগকে কেন্দ্র করে সরকার তুমুল চাপের মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে গেছে ভারতের নাম। ভারত অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী জুগানাথের পাশেই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, তাতে মরিশাস সংকটের সুরাহা হচ্ছে না বরং তা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। দেশটির বিরোধী দলগুলো এখন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চরম দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে তার ইস্তফার দাবিতে পার্লামন্টের ভেতরে ও বাইরে তীব্র আন্দোলনও শুরু করেছে।
এর আগে, ৩০ জুন মরিশাস টেলিকমের সিইও হিসেবে সাত বছর দায়িত্ব পালনের পর সরকারঘনিষ্ঠ এবং প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত শেরি সিং হঠাৎ পদত্যাগ করেন। সে সময় তিনি সংস্থার কর্মীদের উদ্দেশে এক বার্তায় লেখেন, মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। পরে, স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশনে ও লাইভ টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে শেরি সিং জানান, মরিশাসের বে-দ্যু-জাকোতে অবস্থিত সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশনে বাইরের লোকদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি বিদেশি টিমকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
এখানে সরাসরি ভারতের নাম না বললেও ভারতের অনুরোধেই যে প্রধানমন্ত্রী জুগানাথ এই অনুমতি দিয়েছিলেন, শেরি সিং সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মূল উদ্দেশ্য ছিল সেখানে একটি স্নিফিং ডিভাইস বসানো যার মাধ্যমে দেশের ইন্টারনেট ট্রাফিকের ওপর নজরদারি চালানো যায়।
L’homme, flegmatique à souhait, a en effet balancé des jets d’eau et peut-être de flegmes dans la nature verdoyante, au beau milieu des fleurs, après avoir avalé plusieurs gorgées d’eau. https://t.co/KvtS8jbbiH
— l'express (@lexpressmaurice) July 24, 2022
এরই মধ্যে, স্থানীয় ল’এক্সপ্রেস পত্রিকায় ওই ল্যান্ডিং স্টেশনের একটি সিসিটিভি ফুটেজের ছবি বের হয়। তাতে একজন গোঁফওয়ালা ভারতীয় ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে। তাকে বলা হচ্ছে মরিশাসে যাওয়া ভারতীয় টেকনিক্যাল টিমের নেতা কে রাধাকৃষ্ণ। শুক্রবার (২২ জুলাই) রেডিওতে আর একটি ইন্টারভিউ দিয়ে শেরি সিং-ও জানান, ভারতের টেকনিক্যাল টিমের নেতার পরিচয় তাদেরও অজানা ছিল। তবে তার বড় গোঁফ ছিল। তিনি ওই ব্যক্তিকে ‘মুশটাচ ম্যান’ বলেই উল্লেখ করেন। এই ‘মুশটাচ ম্যান’ কীভাবে মরিশাসের অত্যন্ত স্পর্শকাতর ওই ইন্টারনেট ল্যান্ডিং স্টেশনে যেতে পারলেন, তা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন।
এ নিয়ে ৫ জুলাই মরিশাসের বিরোধী দলগুলো পার্লামেন্টে সরকারকে চেপে ধরে। প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জুগানাথ সে দিনই পার্লামেন্টে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, মরিশাসের ইন্টারনেট ট্রাফিকে নজরদারি, আড়ি পাতা, মনিটরিং বা রেকর্ডিংয়ের জন্য তিনি কখনোই কোনো ডিভাইস বসানোর কথা বলেননি। কিন্তু, তার পর দিনই আর একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সাবমেরিন কেবল প্রকল্পের একটি নিরাপত্তা ইস্যুতে মরিশাসে একটি সার্ভে করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে শ্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেন সার্ভের জন্য একটি সুদক্ষ দল পাঠাতে। তিনি বলেন, ওই কাজের জন্য সক্ষম টেকনিক্যাল টিম মরিশাসে ছিল না। তাই তারা চেয়েছিলেন ভারত থেকেই টেকনিক্যাল দল আসুক। এছাড়াও, মরিশাস টেলিকমের সিইও শেরি সিং এ কাজে অসহযোগিতা করেছেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাকে ভারতের কাছে অস্বস্তিতেও পড়তে হয়েছিল।
এরপর শনিবার (২৩ জুলাই) থেকেই মরিশাসের বিরোধীদলগুলো সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে। দেশের অন্তত দুই জন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুগানাথের পদত্যাগ দাবি করে বিবৃতি দেন। বিরোধী লেবার পার্টির নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নভিন রামগুলাম বলেন, জুগানাথ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ও মরিশাসবাসীর কাছে মিথ্যা বলেছেন। ইন্টারনেট ল্যান্ডিং স্টেশনে স্নিফিং ডিভাইস বসাতে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছেন এবং এই কাজ চরম দেশদ্রোহিতার সামিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বিরোধী এমএমএম পার্টির নেতা ও আর এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল বেরেঙ্গারও দাবি জানিয়েছেন, ওরকম একটি স্পর্শকাতর এলাকায় কেনো ভারতের টেকনিক্যাল দলকে যেতে দেওয়া হলো ও সার্ভে করতে দেওয়া হলো; সরকারকে সেই কৈফিয়ত দিতে হবে। তিনিও প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জুগানাথের অবিলম্বে ইস্তফা দাবি করেছেন।
মরিশাসের বিরোধী দলগুলো এ বিতর্কে তাদের প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি ভারতকেও নিশানা করছে। কেন একজন ভারতীয় নাগরিক, কুমারেসান ইলাঙ্গো-কে মরিশাসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে তারা এখন সে প্রশ্নও তুলছেন। ভারত অবশ্য এই আগাগোড়াই এই বিতর্ককে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করে আসছে। বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) এ বিষয়ে নির্দিষ্ট এক প্রশ্নের জবাবে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার সঙ্গে তাদের বাড়তি কিছু যোগ করার নেই।
প্রসঙ্গত, এই প্রকল্পে শুধু ভারত বা মরিশাসই নয় মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ফ্রান্সের রিইউনিয়ন আইল্যান্ডের মতো অন্যান্য দেশও যুক্ত। মালয়েশিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার লম্বা সাউথ আফ্রিকা ফার ইস্ট বা সেফ কেবলের খুব গুরুত্বপূর্ণ এই হাব বা ল্যান্ডিং স্টেশনটি মরিশাসে অবস্থিত।
সারাবাংলা/একেএম
ইন্টারনেট ল্যান্ডিং স্টেশন ইন্টারনেটে নজরদারি গোপন নজরদারি টপ নিউজ ভারত মরিশাস স্নিফিং ডিভাইস