বিষাদের সুর ঘেঁষে নব আনন্দের বার্তা
২৭ জুন ২০২২ ১২:১৯
ঢাকা: উদ্বোধনের পরদিন সোমবার (২৬ জুন) সবার জন্য খুলে দেওয়া হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মাসেতু। সকাল ছয়টা থেকে সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে টোল গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় সবধরনের যান চলাচল। যাত্রীবাহী বাস, মিনিবাস, কার, মাইক্রোবাসের পাশাপাশি চলতে শুরু করে বিভিন্ন আকারের কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক ইত্যাদি। পাশাপাশি মোটরসাইকেলে অসংখ্য মানুষ প্রথমবারের মত সেতু অতিক্রম করে পার হয় প্রমত্তা পদ্মা। এদের মধ্যে অনেকেই শুধু প্রয়োজনে নয়, শুধুমাত্র প্রথমদিন পদ্মাসেতু পারাপারের ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গী হতে আসেন রোববার।
একদিকে স্বপ্নের পদ্মাসেতুতে যখন চলছে উৎসবের আবহ, বিষাদের সুর বইতে দেখা যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের নদী পারাপারের স্থল মাওয়া ঘাটে। একই আছে সেই ফেরি ও লঞ্চ ঘাটের পন্টুন, ঘাটের তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য ছোটবড় ভাতের হোটেলের সারি, শুধু নাই গমগমে মানুষের ভিড়। নদীর তীরে তখনও কিছু ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা অলস বসে আছে। নদীর বুকে দুটো ফেরি আর কিছু লঞ্চ বাঁধা। কয়েকটি লঞ্চে যাত্রী চলাচল চালু থাকায় কিছুটা কিছুটা মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে সোমবার দুপুরে। কেউ কেউ আবার ফেরির পন্টুনে ও নদী তীরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন টিপটিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে।
ফেরিঘাটে নোঙর করা অবস্থায় চোখে পড়ে দুটি ফেরি- বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়া। ঘাটের লাগোয়া থাকায় বেগম সুফিয়া কামাল সেতুতে ওঠা হয় এ প্রতিবেদকের। ফাঁকা ফেরিতে কথা হয় ফেরির লস্কর নুর জামান। লস্কর হিসেবে তার কাজ ফেরি ধরা, বাঁধা, লাইন ধরে গাড়ি ওঠানো-নামানো, সেগুলো ফেরিতে ঠিকমত রাখা ইত্যাদি।
২০২১ সাল থেকে এই ফেরিতে কাজ করেন। বর্তমানে মাওয়া ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অপেক্ষায় আছেন দেশের অন্য কোনো ফেরিতে স্থানান্তরের।
প্রায় বছরখানেক মাওয়া ঘাটে কাজ করেছেন, গাড়ি আর মানুষে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জমজমাট থাকত এই ফেরিঘাট আর ফেরি। আজ সেখানে প্রায় সুনসান নীরবতা কেমন লাগছে নুর জামানের। সন্দ্বীপের বাসিন্দা নুর জামানের সকাল থেকেই মনটা মরা মরা লাগছে। তিনি বলেন, ‘গাড়ি তো গাড়ি এখানে আজ মানুষই নাই। অথচ অন্যদিন এখানে গমগমে ব্যস্ততা থাকে। কত কাজ, কত মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। তবে এখানে শূন্যতা থাকলেও অদূরে পদ্মাসেতু দেখলে দারুণ ভালো লাগায় বুক ভরে যায় নুর জামানের। বলেন, মনের আবেগ তো আছেই এই সেতু ঘিরে। কিন্তু আবেগের চেয়েও সেতুটা দেখতেও সুন্দর লাগে।’
অপেক্ষার সময় বাদ দিয়ে ফেরিতে শুধুমাত্র নদী পার হতেই তাদের সর্বনিম্ন এক ঘণ্টা সময় লাগত। বর্ষাকালে তো সেই সময় আরও ২০ থেকে ৩০ মিনিট বেড়ে যেত। বর্তমানে সেতুতে কয়েক মিনিটে নদী পার হওয়া যাবে এটি চিন্তা করেই তার ভালো লাগছে।
ফেরি ও ঘাটে সাত বছর ধরে কুলফি আইসক্রিম বিক্রি করেন কুষ্টিয়ার শফিক। বিক্রি-বাট্টা কম হওয়ায় মন কিছুটা খারাপ। অন্যান্যদিন দুপুর নাগাদ ৬০০-৭০০ টাকা থেকে হাজার টাকা বিক্রি হয়ে গেলেও আজ দুপুর দুটো নাগাদ তিনি মাত্র ১৫০ টাকার কুলফি আইসক্রিম বিক্রি করতে পেরেছেন। ঘাটে যদি মানুষ আসা কমে যায় তাহলে পেশা বদলের চিন্তা করছেন তিনি।
মাওয়া ঘাটে ভ্যানের অস্থায়ী দোকানে পাঁচ বছর ধরে পানি, চিপস, টিস্যু, চকলেট বিক্রি করেন লিমন। গতকাল থেকে বিক্রি অনেক কমে গেলেও লিমন অবশ্য পেশা বদলের চিন্তা করছেন না। কারণ, তার মূল ক্রেতা রাতে মাওয়া ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীরা। এখন অবশ্য রাতেও কিছুটা দর্শনার্থী কমে গেছে। লিমন আশা করছেন, নতুন নতুন পদ্মাসেতু হওয়ার কারণে মানুষ সেখানে ঘুরতে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই রাতে আবারও জমজমাট হয়ে উঠবে পদ্মাপাড়ে ইলিশ খেতে যাওয়া জনতার ভিড়ে।
পাশেই ডাব বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল। ছয় বছর ধরে ডাব বিক্রি করেন মাওয়া ঘাটে। বিক্রিবাট্টা কমে গেলেও হতাশ নন তিনি। তার একক ব্যবসার চেয়েও পদ্মাসেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সম্ভাবনার যে নতুন দুয়ার উন্মোচন হল সেটিই তাকে অনেক আনন্দিত করছে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, বিষয়টা তো খালি আমাদের পঞ্চাশ-একশজন ডাবওয়ালার না। সারাদেশের মানুষের সুবিধা লাগবে। খালি আমরা কয়েকজন না, সারাদেশে মানুষ যেন সুখি হয় সেটাই আমাদের ভাবা দরকার। ফেরি বন্ধ হওয়ায় আমার ডাব বিক্রি কমে গেলেও এখন আমি অন্য কাজ করতে পারব, ঢাকায় যেতে পারবো সেটাও তো কম না।
এভাবে পদ্মা নদীর তীরে মাওয়া-বাংলাবাজার নৌ চলাচল ঘিরে কয়েক দশকের জমজমাট মাওয়া ঘাট। দিন-রাত যাত্রীর ভিড়ে গমগম করা এই এলাকা পদ্মাসেতু হওয়ায় কিছুটা ম্লান মনে হলেও এখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল এতদিনের পরিচিত কর্মস্থল বদলানোর জন্য কিছুটা স্মৃতিকাতরতা কাজ করলেও পদ্মাসেতু ঘিরে জাতীয় অর্থনীতি বদলে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাতেই তারা সন্তুষ্ট।
সারাবাংলা/আরএফ/একে