বাংলাদেশের ভয়াবহ যত বন্যা
১৭ জুন ২০২২ ১৯:১৮ | আপডেট: ২০ জুন ২০২২ ১৫:৫৩
বাংলাদেশ প্রকৃতিগতভাবেই বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি। ঝড়-জলের সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেড়ে ওঠা। নাতিশীতোষ্ণ এই দেশে বছর ঘোরে ছয় ঋতুর দোলাচলে। তবে এখন ষড়ঋতুর দেখা আর না মিললেও গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতের পরিধি ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে আরোপিত কিছু ভোগান্তিও। গ্রীষ্মে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রচণ্ড তাপ, বর্ষায় দুর্নীতি আর কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফাঁদে জলাবদ্ধতা-বন্যা, আর শীতে জলবায়ু ইস্যুতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ— এর সঙ্গেই বসবাস আমাদের।
বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ছোট বড় প্রায় ২৩০টি নদী বয়ে গেছে। মূলত এ জন্যই অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বন্যা বেশি হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ দেশে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। এই সময়ে দেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলো হিমালয়ের বরফগলা ও উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টিতে পানির উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং বন্যায় প্লাবিত হয়। ভেসে যায় ফসল, পশু-পাখি। তৈরি হয় মানবিক বিপর্য়য়ও। প্রতিবছরই আমাদের ছোট-বড় বন্যার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে কোনো কোনো বছরের বন্যার ভয়াবহতা ভুলবার নয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রেক্ষাপটেও ছিল সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ছেষট্টির বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। ১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। ওই বন্যায় উপকূলের ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় ১২ লাখ ৯৮ হাজার টন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়েছিল।
এরপরও বাংলাদেশে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে বহুবার। বিশেষ করে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে প্রায় গোটা বাংলাদেশজুড়ে বড় বন্যা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে বহুবার।
১৯৮৭ সালের বন্যা
সাতাশির এপ্রিল থেকেই দেশে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। নদ-নদীগুলো ভরে উঠেছিল সেই পানিতে। জুলাইয়ের শুরুর দিকে ভারতের নদীগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের নিচু অঞ্চলগুলো বিশেষ করে খুলনার উত্তরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়। ১৯৮৭ সালে বন্যা স্থায়ী হয়েছিল জুলাই থেকে আগস্ট মাসের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা।
১৯৮৮ সালের বন্যা
আটাশির বন্যা ছিল বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাসে ল্যান্ডমার্ক। এখনো অনেকে কথাপ্রসঙ্গে আটাশির ভয়ংকর বন্যার উদাহরণ টানেন। বর্ষার প্রায় শেষ ভাগে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাস স্থায়ী এই বন্যায় দেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে প্রচণ্ড জনদুর্ভোগ হয়েছিল সেই বন্যায়। আর সেই জনদুর্ভোগ বিশ্বগণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় আটাশির বন্যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সাতাশি সালের মতো আটাশির প্রলয়ংকারী বন্যার মূল কারণও ছিল সারাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভারতের নদ-নদী থেকে নেমে আসা পানি। দেশের প্রধান তিনটি নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে রাজধানী ঢাকা শহরও বিপুলভাবে প্লাবিত হয়েছিল সেই বন্যায়। রাজধানীর ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ হয়ে পড়েছিল ঘরবন্দি। ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর, গুলিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু অংশ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব এলাকাই জলমগ্ন হয়েছিল। সে বছর ঢাকায় প্রায় ৪০০ ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। এসব ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ বন্যার্ত। ওই বন্যায় মারা যায় প্রায় ২৩০ জন। এ ছাড়া কয়েক হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল। আর সেই সময়ের হিসেবে কয়েক হাজার কোটি টাকার অর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
১৯৯৮ সালের বন্যা
আটানব্বয়ের বন্যা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। আড়াই মাসেরও বেশি সময়জুড়ে চলা এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকার ১ লাখ ২৫০ বর্গ কিলোমিটার প্লাবিত হয়। অর্থাৎ দেশের ৫২টি জেলাসহ মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। ওইসব এলাকার অসংখ্য মানুষ হয়ে পড়েন ঘরবন্দি। সেবারের বন্যার কারণও ছিল একই— সারাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানির ঢল।
প্রায় ৮০ দিন স্থায়ী এই বন্যায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে ডুবে ছিল দীর্ঘদিন। ফলে ওই বছরে খাদ্য ঘাটতি হয় প্রায় ২১৮ লাখ মেট্রিক টন। আটানব্বয়ের বন্যার শেষ দিকে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই বছর শিশুসহ মারা যায় ১৫ শতাধিক মানুষ।
২০০০ সালের বন্যা
অনেকটা আকস্মিকভাবেই এসেছিল ২০০০ সালের বন্যা। ওই বছরের আগস্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আগস্টের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় মাটির বাঁধ ভেঙে যায়। আর এতেই হুড়মুড় করে পানি ঢুকতে থাকে বাংলাদেশে। বন্যায় রাতারাতি বিধ্বস্ত হয় ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি জেলা।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরব্যাপী ওই বন্যায় বাংলাদেশের ৯টি জেলার প্রায় ৪১টি উপজেলার ২৮০টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। ৮ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারায়। প্রায় ৩০ লাখ লোক এই বন্যায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
২০০৭ সালের বন্যা
এই বছরটি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বছর। একই বছরে বন্যা, খরা, নদী ভাঙন, ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস সামাল দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০০৭ সালের বন্যাও ছিল আটানব্বইয়ের বন্যার মতো দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বব্যাপী। সেপ্টেম্বর মাসের এ বন্যায় দেশের মোট আয়তনের ৬২ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
জুলাইতে প্রথম ধাপে এক বন্যার পর সেপ্টেম্বরে দেশে আকস্মিকভাবে আবারও অস্বাভাবিক বন্যা হয়। ডুবে যায় ৪২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। পরপর দুইবারের বন্যায় প্রায় ১৪ লাখ টন ফসল খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। ওই বছরে খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল প্রায় ১৯ লাখ টন।
২০১৭ সালের বন্যা
এলাকাভিত্তিক ‘অতি ভয়াবহ’ এই বন্যায় দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো ভয়ংকর ক্ষতির মুখে পড়ে।
জুলাই-আগস্ট মাসের এই বন্যায় দেশের প্রায় ৩৭ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ডুবে যায়। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে।
এসব জেলায় জানমাল ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক। বন্যার পানির তোড়ে সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ ও রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
সারাবাংলা/এসবিডিই