বিচার বহির্ভূত হত্যা-গুমের অভিযোগ, ইসি বিলুপ্তির প্রস্তাব!
১৪ জুন ২০২২ ০০:৩৬ | আপডেট: ১৪ জুন ২০২২ ০০:৪২
ঢাকা: ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন কমিশনই বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করেছেন তারা।
সোমবার (১৩ জুন) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত দাবিরও বিরোধিতা করেন।
বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা বলেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আমরা কি দায়বদ্ধ পুলিশ বাহিনী গড়তে পারছি? পুলিশের হাতে মানুষের হয়রানি নিত্যদিনের ঘটনা। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে জনগণকে কর্মচারী মনে করে। এসব ঘটনায় পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। পুলিশকে দায়বদ্ধ করা প্রয়োজন। সেটা করা গেলে বিদেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসত না। মানবাধিকার বিষয়ক সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে দায়বদ্ধহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে জবাব দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এসব বক্তব্য রাজনৈতিক। পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। পুলিশ বাহিনীতেও কেউ অপরাধ করলে কেউই রেহাই পাচ্ছে না। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্যের অপরাধে জড়িত থাকার কারণে বিচার হয়েছে। অনেকে চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। সাজা পর্যন্ত খাটছেন। পুলিশ বিভাগে কেউ অন্যায় করলে সরকার বরদাস্ত করে না, অ্যাকশন নেয়।
আলেচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আজ পুলিশের কেউ অন্যায় করলে মানবাধিকার কমিশন নিশ্চুপ থাকে। কোনো পুলিশ অন্যায় করলে সব পুলিশ একত্রিত হয়ে তাকে সমর্থন দেয়। ফলে অসহায় হয়ে যায় বিচার বিভাগ। জনগণের অধিকার লঙ্ঘিত হলেও তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। পুলিশের দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। পুলিশ মনে করে অস্ত্র তার হাতে। তার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তারা সীমাহীন ক্ষমতার মালিক। সংসদে মানবাধিকার বিষয়ক সর্বদলীয় বিশেষ কমিটি করার প্রস্তাব করেন তিনি।
বিএনপির সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ বলেন, পুলিশ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদেরর বিরুদ্ধে মামলার বাদী ও সাক্ষী হয়। এটাই প্রমাণ করে, দেশের বিচারব্যবস্থা কতটা নাজুক। সরকারি দল চায় পুলিশ তাদের কথামতো চলবে। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করে ক্ষোভ জানিয়ে এমপি হারুন বলেন, নির্বাচন কমিশন বিলুপ্ত করে দেন। এটাকে পুলিশ বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করেন। কী প্রয়োজন, খামাখা! পুলিশের আইজিপিকে প্রধান করে দেন। তাদের অধীনে নির্বাচন দেন। এ বিষয়ে আইন করেন সংসদে। সেইভাবে আগামী নির্বাচন হবে।
বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়, পুলিশ পরিণত হয়েছে দলীয় বাহিনীতে। নতুন বিপদের আশঙ্কায় মহাবিপদে পড়লেও মানুষ পুলিশের কাছে যেতে চায় না। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচার বহির্ভূত হত্যা-গুম তো রয়েছেই।
গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, পুলিশ বাহিনীর কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতিবাজদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাজেটের বিরোধিতা
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাজেটে অতিরিক্ত দাবির বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য খাতে বেহাল দশার কারণে আস্থা হারিয়ে মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দিয়ে এই মন্ত্রণালয় প্রশংসনীয় কাজ করলেও মিঠু সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা মোকাবিলা ও ভ্যাকসিন প্রদানে সক্ষম হয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বের কারণে। করোনার জন্য কোনো বেড ছিল না। ২০ হাজার বেড স্থাপন করেছি। ১০০টি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। ১০ হাজার ডাক্তার ও ২০ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে।
মন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর মধ্যে যে কয়েকটি দেশ প্রথম ভ্যাকসিন পেয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯ কোটি ভ্যাকসিন কিনেছি। ১০ কোটি ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পেয়েছি। করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায়। এত বিশাল কর্মযজ্ঞের পরও বিরোধী পক্ষ থেকে প্রশংসা পাইনি। ঢালাওভাবে দুর্নীতির কথা বলা হয়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলেন না। যারাই দুর্নীতি করেছে, তাদেরই জেলে পাঠিয়েছি, কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।
স্থানীয় সরকার বিভাগ
স্থানীয় সরকার বিভাগের বাজেটে অতিরিক্ত দাবির বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা বলেন, সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিদের নয়, আমলাদের ওপর সরকার সব ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এতে জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের কারণে ভালো কাজ করতে পারছে না। আমলানির্ভরতা না কমালে স্থানীয় পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না।
জবাবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, কিছু হলেই আমরা আমলাদের সমালোচনা করি। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। সরকার তাদের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই কাজ হয়। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমলারা কাজ করছেন। সংসদ সদস্যদের মাধ্যমের ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা জনগণের স্বার্থে ব্যয় হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
এই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধিতা করে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা বলেন, টিআর-কবিখা থেকে শুরু করে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অনিয়মের কথা প্রতিমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। এই মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। বন্যা-বজ্রপাতসহ অন্যান্য দুর্যোগে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার কাজ করলেও এই মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা নেই। তাই এই মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
জবাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দেশ যখন আনন্দে মাতছে, তখন সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপো, ট্রেন ও লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড আমাদেরকে ২০১৩-১৪ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল হয়েছে। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা সবাই স্বীকার করেছেন। বজ্রপাত, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেন তিনি।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর