প্রসূতি ওটিতে, তালাবদ্ধ রেখে পালালেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা
২৯ মে ২০২২ ২১:০৩ | আপডেট: ৩০ মে ২০২২ ০৯:৪৮
ঢাকা: ঘটনাস্থল রাজধানীর ঠিক উপকণ্ঠেই চিটাগাং রোড এলাকার পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল। কিছু সময় আগেই সেখানে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন এক প্রসূতি। অস্ত্রোপচারকক্ষ (ওটি) থেকে নবজাতককে কেবিনে স্বজনদের দেওয়া হয়েছে মাত্রই। প্রসূতি তখনো ওটিতেই। এমন সময় হঠাৎ করেই ওটিতে তালা দিয়ে সটকে পড়ল পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রসূতির স্বজনদের তখন মাথায় হাত!
রোববার (২৯ মে) দেখা যায় এমন চিত্র। জানা গেল, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে— এমন খবর পেয়েই দ্রুত সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে গেছেন ওই হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শুধু তাই নয়, ভবনের সামনে রীতিমতো ‘হাসপাতাল বন্ধ’ নোটিশ ঝুলিয়ে গেছেন তারা।
পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের ওই ওটির পাশেই কেবিন, যেখানে স্বজনদের কোলে নবজাতক। সামনেই অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন নবজাতকটির বাবা। বললেন, সকালেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তার স্ত্রীকে। সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভর্তির ১০ মিনিটের মধ্যেই তাকে ওটিতে নেওয়া হয়। এরপর নবজাতককে কেবিনে দিলেও তার স্ত্রীকে ওটিতে তালাবদ্ধ অবস্থায় আটকে রেখেই পালিয়ে গেছেন হাসপাতালের কর্মীরা।
ওই ব্যক্তি বলেন, বাচ্চার মা সুস্থ আছে নাকি অস্ত্রোপচারের সময় কোনো সমস্যা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছুই জানি না। বাচ্চারও কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তাকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক, নার্স বা কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানের খবর পেয়ে ভেতরে রোগী রেখেই পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতাল ভবনের সামনে তারা ঝুলিয়ে দিয়ে যান— ‘হাসপাতাল বন্ধ’ নোটিশ। রোগী পরিচয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করা হলেও জানানো হয়, ভেতরে কেউ নেই। পরে গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকলেও দেখা যায় নিচ তলা প্রায় ফাঁকা।
হাসপাতালের তৃতীয় তলায় দেখা যায় কেবিনে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনদের। কথা বলে জানা যায়, তারা সবাই প্রসূতিকে নিয়ে এসেছেন সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য। এসময় এই তলাতেও হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী বা অন্য কাউকে দেখা যায়নি। হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের দরজার লক ভেঙে ভেতরে ঢুকতে ওই প্রসূতিকে অস্ত্রোপচারের শয্যাতেই শুয়ে থাকতে দেখা গেল।
কেবিনে থাকা আরেক রোগীর স্বজন জানালেন, এক দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন তারা। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেও এখন পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তবে দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাদের। কোনো চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেছেন নাকি অন্য কেউ, তাও বলতে পারছেন না তিনি। কারণ হাসপাতালে আসার পর থেকে মাঝে মধ্যে নার্সকে দেখা গেলেও কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারেননি তারা।
হাসপাতালের আশপাশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রায় প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হন এই হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সেও বিভিন্ন রোগীকে আনা হয় এই হাসপাতালে।
পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা আসেন এই হাসপাতালে। তারা হাসপাতালের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, কোনো ধরনের অনুমোদন নেই প্রতিষ্ঠানটির। এমনকি কোনো ধরনের ল্যাবরেটরিভিত্তিক নমুনা পরীক্ষা করানোর অনুমোদনও নেই। তাই এটি বন্ধ ঘোষণা করা হবে। তবে এর আগে রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বাস দেন তারা। পরে তাদের উদ্যোগেই স্ট্রেচারে করে পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীদের মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর হাসপাতালটি বন্ধ ঘোষণা করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. মো. বেলাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান কঠোর। শুধু পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নয়, এখন পর্যন্ত (রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) সারাদেশে ৫৩৮টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা শুধু ঢাকাতেই দেড় শতাধিক। আমাদের কাছে দিনের তথ্য এখনো আসছে। এলে আমরা মোট সংখ্যা জানাব। আর অনুমোদনহীন এমন সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান অব্যাহত রাখব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, আমরা অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কারণ অনুমোদনহীন এসব স্থানে গিয়ে রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ুক, তা কেউ চায় না। আর তাই আমরা এখন চেষ্টা করছি সবার জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে, যেন কাউকে দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর