হাতিরঝিলের পানি এবং সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ: হাইকোর্ট
২৪ মে ২০২২ ০৯:১৬ | আপডেট: ২৪ মে ২০২২ ১৭:৪৩
ঢাকা: রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদের কোনো ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য মামলার রায়ে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৫৫ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিটি প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘প্রতিটি ফোটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ এ পৃথিবীতে নাই। সুতরাং প্রতিটি ফোটা পানির দূষণ প্রতিরোধ করা একান্ত আবশ্যক।’
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, “There is no ‘planet B’। দ্বিতীয় কোনো পৃথিবী নেই। এ পৃথিবী ব্যতিত আর কোনো গ্রহে পানির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় নাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এক ফোটা পানি এ পৃথিবীর বাইরে থেকে আনতে সক্ষম হয় নাই। অথচ এই খরচের শত ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করলে আমরা আমাদের গ্রহের পানিকে দূষণ মুক্ত ব্যবহারযোগ্য রাখতে সক্ষম। হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনোরূপ ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না।’
রায়ে রিট মামলাটি একটি চলমান আদেশ (Continuing Mandamus) হিসেবে অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া যেসব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাতিরঝিল ও পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক প্রচারণা ও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে রায়ে তাদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে হাতিরঝিল সম্পর্কে বলা হয়, হাতিরঝিলসহ তেজগাঁও এলাকায় অনেক ভূসম্পত্তি ভাওয়াল রাজার এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজার হাতির পাল এই ঝিলে স্নান করতো এবং জলে বিচরণ করতো বলে, কালের পরিক্রমায়, এর নাম হয় ‘হাতির ঝিল’। বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ১ হাজার ৯৭১.৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩০২ একর জমির উপর এ প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত। প্রকল্প এলাকার মোট ১৬ কি.মি. রাস্তায় কোন বাস অথবা মিনিবাস চলাচলের অনুমতি ছিল না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫/২০০৯তম সভায় অনুমোদিত লে-আউটে প্রস্তাবিত ওয়াকওয়ে ও রোডওয়ে এলাইনমেন্ট ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।
প্রকল্পটি ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, বৃষ্টি, বন্যাজনিত পানি ধারণ, বৃষ্টির পানি পয়ঃনিষ্কাশন ও নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে এবং সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।খালগুলোর জন্য প্রস্তাবিত সুবিশাল লেকটি একটি নিয়ন্ত্রিত ‘হাইড্রোলিক সিস্টেম’ হিসাবে কার্যকর হয়। এতে ওই এলাকার ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পায়, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ও সৌন্দর্যমন্ডিত পাবলিক স্পেসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। রমনার পাশাপাশি একটি সুবিশাল নীল জলাধার বেষ্টিত উন্মুক্ত স্থানের অভাব লাঘব হয়। যা বিশ্বের কাছে ঢাকা মহানগরীর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেছেন, মানবজাতির জন্য একান্ত অপরিহার্য এবং সেহেতু সব জলাভূমি (Wetlands), লেক (Lake) এবং বিল সংরক্ষণ করা আমাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য একান্ত অপরিহার্য এবং যেহেতু রিটের প্রতিপক্ষরা (বিবাদীরা) বেআইনিভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট তথা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ দিয়ে হাতিরবিল প্রকল্প এলাকার মূল্যবান সুপেয় পানি এবং এর উপরিস্থিত ও পারিপার্শ্বিক নান্দনিক সৌন্দর্য দূষণ ও নষ্ট করছে।
হাইকোর্ট রায়ে হাতিরঝিলের পানি এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও মহামূল্যবান এই জাতীয় সম্পত্তি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো-
১. সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় মোতাবেক রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি (Public Trust Property) তথ্য জনগণের ন্যাস সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি।
২. হাতিরঝিল এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সকল প্রকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ এবং নির্মাণ-সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদীর রায় অনুযায়ী বেআইনি এবং অবৈধ।
৩. হাতিরবিল প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দকৃত সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে এসব বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো।
৪. অত্র রায়ের অনুলিপি প্রাপ্তির পরবর্তী ৬০ দিনে মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য প্রতিপক্ষদের (রিটের বিবাদী) নির্দেশ দেওয়া হলো।
এছাড়া আদালত হাতির ঝিলের বিষয়ে ৯ দফা পরামর্শ দেয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টকে পাবলিক ট্রাস্ট (জনগণের সম্পত্তি) ঘোষণা করে গত বছরের ৩০ জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী।
এর আগে, হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টে লে-আউট প্লানের নির্দেশনার বাইরে কতিপয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধে রাজউকের নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টম্বর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে ২০২১ সালের ৩০ জুন ওই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এমও