বিদেশি ডাকে আসা পিস্তল ‘প্রাণঘাতী’ নয়, বলছে সিআইডি
৮ মে ২০২২ ২২:০৬ | আপডেট: ৯ মে ২০২২ ০০:১৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আড়াই মাস আগে চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিদেশি ডাকের চালানে আসা অস্ত্রগুলো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নয় বলে সিআইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, জব্দ করা পিস্তলগুলো প্রাণঘাতী নয়। এসব অস্ত্র নিছক ক্রীড়াক্ষেত্রে শুটিংয়ে এবং সিনেমাতেও শুটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। পিস্তলের সঙ্গে জব্দ করা কার্তুজগুলোতে বিস্ফোরক থাকলেও বুলেট নেই। এর ফলে কার্তুজগুলোও প্রাণ হরণকারী নয়।
তবে সিআইডির এই প্রতিবেদন ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে মনে করছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। জব্দ অস্ত্র ও কার্তুজ আদালতের নির্দেশে ফের ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালিস্টিক শাখায় পাঠানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন-
- বিদেশি ডাকে পিস্তল: আয়কর কর্মচারী গ্রেফতার
- বিদেশি ডাকে পিস্তল: মামলায় আসামি প্রেরক-প্রাপক
- বিদেশি ডাকে গৃহস্থালি পণ্যের চালানে এলো পিস্তল-কার্তুজ
- হঠাৎ অস্ত্রের চালান নিয়ে দেশে কেন ‘যুবদল ক্যাডার’ রাজীব?
গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে বৈদেশিক ডাকের একটি চালানে গৃহস্থালি ও প্রসাধনী সামগ্রীর সঙ্গে থাকা চারটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে দু’টি ইতালিতে তৈরি এইট এমএম পিস্তলের সঙ্গে ছিল ৬০ রাউন্ড কার্তুজ। বাকি দু’টি খেলনা পিস্তল বলে ওই সময় পুলিশ জানিয়েছিল।
এ ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে চালানের প্রেরক রাজীব বড়ুয়া ও প্রাপক মজুমদার কামরুল হাসানকে আসামি করে বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন।
জব্দ অস্ত্র ও কার্তুজ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৭ এপ্রিল সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফয়সাল সরোয়ার। ১৩ এপ্রিল সিআইডির চট্টগ্রামের ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালিস্টিক বিশারদ উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) গোলাম আহমদ প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে।
প্রতিবেদনে চারটি মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জব্দ পিস্তল (যেগুলো খেলনা হিসেবে শনাক্ত হয়নি) দু’টি এইট এমএম ক্যালিবারের ব্ল্যাংক ফায়ারিং পিস্তল। এগুলো দিয়ে ফায়ারের ফলে কোনো প্রোজেক্টাইল (প্রক্ষিপ্ত) নিক্ষেপ করা করা যায় না। তাই এগুলো আগ্নেয়াস্ত্র নয়। তবে পিস্তল দু’টি বর্তমানে সচল আছে।
খেলনা হিসেবে শনাক্ত দুটি পিস্তলের বিষয়ে বলা হয়েছে, এগুলো এয়ারসফট পিস্তল। এগুলো দ্বারা বিস্ফোরক দ্রব্যের বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট গ্যাসের চাপের শক্তিতে প্রোজেক্টাইল নিক্ষেপ করা যায় না। ফলে এগুলোও আগ্নেয়াস্ত্র নয়।
জব্দ কার্তুজগুলো পাওয়া গেছে চার ধরনের। সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইট এমএম ও নাইন এমএম ক্যালিবারের কার্তুজ যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো প্রোজেক্টাইলবিহীন। ছয়টি এয়ারসফট সেলের কার্তুজও পাওয়া গেছে, যেগুলোতে প্রকৃত কার্তুজের উপাদান গান পাউডার ও পারক্যাপশন ক্যাপ অনুপস্থিত।
জানতে চাইলে সিআইডির চট্টগ্রামের ফরেনসিক ল্যাবের এসআই গোলাম আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিস্তলগুলো খেলনা নয়, তবে ক্রীড়াঙ্গনে শুটিং প্রতিযোগিতা ও সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহার করা হয়। এগুলো ব্ল্যাংক ফায়ারিং পিস্তল, যেগুলোর লাইসেন্স লাগে না। এগুলোর ট্রিগার চাপলে শব্দ হবে শুধু, বুলেট বের হবে না। এসব পিস্তলে ব্যবহারযোগ্য আলাদা কার্তুজ আছে। এগুলো প্রাণঘাতী নয়। এগুলো দিয়ে মানুষ মারা যাবে না।’
কার্তুজের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব কার্তুজ জব্দ পিস্তলের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। কার্তুজের খোসা আছে কিন্তু বুলেট নেই। খোসার মধ্যে বিস্ফোরক আছে, তবে সেটা নিশানা ঠিক করে ফায়ার করা যাবে না।’
সিআইডির দেওয়া প্রতিবেদন গত ২২ এপ্রিল আদালতে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বন্দর থানার এসআই ফয়সাল সারোয়ার। তবে সিআইডির মতামতে ‘পিস্তল দু’টি বর্তমানে সচল আছে’ উল্লেখ থাকায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ পিস্তল ও কার্তুজ ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালিস্টিক শাখায় পাঠিয়ে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষার আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পিস্তল দু’টি সচল আছে উল্লেখ থাকলেও সেগুলো টেম্পারিং করে ব্যারেল বা অন্য অংশ লাগিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বা মরণাস্ত্রে রূপান্তর করা যায় কি না, পিস্তল দু’টিতে সংযুক্ত বিভিন্ন অংশ আগ্নেয়াস্ত্রের অংশ কি না— এসব বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ নেই। বিষয়গুলো বিবেচনা করে পুনরায় পরীক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার জন্য সেগুলো ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালিস্টিক শাখায় পাঠানো প্রয়োজন।
জানতে চাইলে এসআই ফয়সাল সারোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘জব্দ পিস্তল আগ্নেয়াস্ত্র নয় বলা হলেও সেগুলো আবার সচল আছে বলা হয়েছে। এটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, প্রতিবেদনটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। সেটি আবার পরীক্ষার জন্য আদালতে আবেদন করেছিলাম। আদালত সম্মতি দিয়েছেন। এখন জব্দ আলামত ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে।’
তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্যের জবাবে সিআইডি কর্মকর্তা গোলাম আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিস্তলগুলো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র নয়, কিন্তু সেগুলো সচল আছে। শুটিংয়ে ব্যবহৃত অস্ত্র কি সচল থাকতে পারে না? এতে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।’
সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের পরীক্ষায় যা পেয়েছি, সেটিই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।’
উল্লেখ্য, মামলার দুই আসামির মধ্যে মজুমদার কামরুল হাসানকে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। কামরুল আয়কর বিভাগে চট্টগ্রামের কর অঞ্চল-১-এর ১২ নম্বর সার্কেলে উপকর কমিশনারের কার্যালয়ে উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন। তার বাসা আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে। বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলায়।
আরেক আসামি রাজীব বড়ুয়ার (৪২) বাসাও আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে ছিল। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজিব রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখীল গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক ফণীভূষণ বড়ুয়ার ছেলে। তার মা গীতা রাণী বড়ুয়া চট্টগ্রাম কাস্টমসের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন।
ঘটনার পর পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কামরুল ও রাজীব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসময়ের ‘যুবদল ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত রাজীব বড়ুয়া। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এরপর লিবিয়া হয়ে ইতালি চলে যান। ইতালি থেকেই বন্ধু কামরুলের নামে চালানটি পাঠিয়েছিলেন রাজীব।
গত কয়েক বছরে আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিকেন্দ্রিক যুবলীগের একটি গ্রুপের সঙ্গে রাজীবের সখ্য গড়ে উঠেছিল, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একজন সহসভাপতির অনুসারী হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় দেন।
পুলিশ জানিয়েছিল, অস্ত্রের চালানটি আটকের সময় রাজীব দেশেই ছিলেন। কামরুলকে গ্রেফতারের পর রাজীবকে ধরতে কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয় পুলিশ।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
টপ নিউজ ফরেনসিক বিদেশি ডাকে পিস্তল ব্যালিস্টিক পরীক্ষা যুবদল ক্যাডার রাজীব বড়ুয়া সিআইডি