Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৪ বছর পর ডিসি হিলে মে দিবসের আয়োজন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ মে ২০২২ ২০:৪৫ | আপডেট: ১ মে ২০২২ ২৩:৫৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাড়ে চার বছর পর চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আয়োজনের প্রাণকেন্দ্র ‘ডিসি হিলের’ বন্ধ দুয়ার খুলেছে। বাংলা বর্ষবরণ ছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য এতদিন অনুমতি পাওয়া না গেলেও এবার উদীচী-বোধন আবৃত্তি পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে মে দিবসের অনুষ্ঠান করতে পেরেছে।

রোববার (১ মে) বিকেলে নগরীর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে ‘মে দিবস উদযাপন পরিষদ’। এ আয়োজনে উদীচী চট্টগ্রাম, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট এবং সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের বিভিন্ন পরিবেশনা ছিল।

বিজ্ঞাপন

উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশের সভাপতিত্বে ও বোধান আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ভবরঞ্জন বণিক, জেলা যুব ইউনিয়নের সহ সাধারণ সম্পাদক রূপন কান্তি ধর এবং জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অ্যানি সেন।

সভায় বক্তারা বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, আজকের বাংলাদেশ তার উল্টোপথে হাঁটছে। একটি মানবতাবাদী, শোষণমুক্ত, সাম্যের বাংলাদেশ ছিল স্বপ্ন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ চলে গেছে পুঁজিপতি শোষকদের নিয়ন্ত্রণে। ১০ টাকা ঋণের জন্য কৃষকের কোমড়ে দড়ি দেওয়া হয় আর ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ যে আত্মসাত করে তাকে ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপীরা দেশের সংসদ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার, সমাজব্যবস্থা-সব দখলে নিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য পাওনা লুট করে তারা দেশের মালিক বনে গেছে। দেশকে লুটেরা পুঁজিপতি, শোষকদের কাছ থেকে ফেরত নিতে হলে আবার সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে বোধন ও সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের শিল্পীরা একক ও বৃন্দ আবৃত্তিতে অংশ নেন। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এছাড়া উদীচী এবং ওডিসির শিল্পীরা নৃত্যে অংশ নেন।

সাড়ে চার বছর পর ডিসি হিলে মে দিবসের আয়োজন নিয়ে জানতে চাইলে উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চন্দন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান করতাম। কিন্তু গত চার বছর আমাদের অনুমতি দেননি জেলা প্রশাসক। এবারও আমরা যথারীতি আবেদন করি। কিন্তু প্রথমে জেলা প্রশাসক নাকচ করে দেন।’

‘এরপর আবার গত (শনিবার) রাত সাড়ে ১১টার দিকে জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চার বছর পর আমরা আবার ডিসি হিলে ফিরেছি। এই সিদ্ধান্তের জন্য জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানাই। একইসঙ্গে প্রগতিশীল সংগঠনগুলো যেন ডিসি হিলের মুক্তমঞ্চ ব্যবহার করতে পারে, এ নিয়ে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা তুলে নেয়ার অনুরোধ করছি।’ এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।

নগরীর নন্দনকাননে দৃষ্টিনন্দন ডিসি হিলের চূড়ায় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সরকারি বাসভবন আছে। আর পাহাড়ের পাদদেশে মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক আয়োজন করত, যার অনুমতি নিতে হত জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। তবে মুক্তমঞ্চ তৈরির আগে থেকেই বাংলা বর্ষবরণের আয়োজন হত ডিসি হিলে।

২০১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে ‘অপরিচ্ছন্নতার’ অজুহাত দিয়ে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ডিসি হিলে বছরে তিনটি ছাড়া অন্য অনুষ্ঠান আয়োজন না করতে আহ্বান জানান। এই তিন অনুষ্ঠান হল- পহেলা বৈশাখ এবং রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী। এরপর থেকেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ডিসি হিলে আর কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

এর প্রতিবাদে তখনই বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু প্রতিবাদের মুখেও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এমনিক জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে ২০১৮ সালে ৪০ বছর ধরে আয়োজিত বর্ষবরণের অনুষ্ঠানও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল। সেসময় চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীরা রাস্তায় নামতেও বাধ্য হয়েছিলেন। ২০২১ সালে চট্টগ্রামের সিআরবি রক্ষার আন্দোলন শুরুর পর একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, সিআরবির পাশাপাশি ডিসি হিল খুলে দেওয়ার জন্যও আন্দোলন শুরু করা হবে।

তবে বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান যোগদানের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ‘নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের’ একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সেসময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ডিসেম্বর থেকে ডিসি হিল খুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক। তবে ডিসেম্বরে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হয়নি।

তবে এবারও পহেলা বৈশাখে যথারীতি বাংলা বর্ষবরণের আয়োজন হয়েছে। এর বাইরে অন্য সংগঠনের জন্য গত সাড়ে চার বছরে প্রথম ডিসি হিলের ফটক খুলেছে। মে দিবস উদযাপন পরিষদকে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়াকে ডিসি হিল পুরোপুরি উন্মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী।

এদিকে মে দিবস উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে সকালে নগরীর চেরাগি চত্বরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. চন্দন দাশের সভাপতিত্বে ও বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম জেলা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মোহাম্মদ মছিউদ্দৌলা এবং কবি কামরুল হাসান বাদল।

শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ মছিউদ্দৌলা বলেন, ‘দেশে চোখ ধাঁধানো নানা উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। দেশ নাকি উন্নত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নয়নের গল্প যত দীর্ঘ হচ্ছে, শোষণ-বঞ্চনাও তত বাড়ছে। দেশ যদি উন্নত হয়, তাহলে এখনও কেন শ্রমিকদের মজুরির জন্য রাজপথে নামতে হয়? কেন পুনর্বাসন ছাড়া হকারদের উচ্ছেদ করা হয়? কেন আজ দেশে শ্রমজীবী মানুষ আরও গরীব হচ্ছে আর পুঁজিপতিরা আরও বড়লোক হচ্ছে? মালিক কেন শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা দেয় না? গরীব মানুষ মেরে বড়লোক হওয়ার এই প্রবণতা, দেশকে উন্নত করার এই প্রবণতা রুখতে হবে। ইতিহাস বলে, রাজপথের লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া কখনও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অধিকার আদায় করতে হবে।’

কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই মূলমন্ত্রে দেশের গরীব-মেহনতি, মধ্যবিত্ত, ধনী সবার কথা আছে। শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির মূলমন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি। আমরা একটি সাম্যের বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে ধনীরা গরীবের ওপর নির্যাতন-জুলুম করবে না, যেখানে ধর্মের নামের মানুষের ওপর নির্যাতন হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ধারায় যদি দেশকে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকতে পারবে না।’

ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘আমরা গানের মধ্য দিয়ে, কবিতার মধ্য দিয়ে, সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এদেশের মেহনতি মানুষকে সংগ্রামের ডাক দিয়ে যাচ্ছি। এদেশের একজন মানুষও যাতে তার ন্যায্য অধিকারটুকু পায়, প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ যাতে একজন সুনাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে, সেজন্য সংগ্রামের প্রয়োজন। সেই সংগ্রাম হতে হবে সংস্কৃতির সংগ্রাম। সংস্কৃতি ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন। মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাগ্রত করতে না পারলে লড়াই-সংগ্রাম বেগবান হবে না।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

আয়োজন টপ নিউজ ডিসি হিল মে দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর