দুই বছর পর বলিখেলা-মেলা, সরগরম লালদিঘী
২৩ এপ্রিল ২০২২ ১৯:১২ | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২২ ০০:১৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো : করোনভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দুইবছর বন্ধ থাকার পর রোববার থেকে আবারও বসছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলিখেলা উপলক্ষে বৈশাখী মেলা। তবে মেলা শুরুর অন্তঃত দুইদিন আগ থেকেই দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে গৃহস্থালি ও লোকজ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসতে শুরু করেছেন দোকানিরা।
শনিবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে নগরীর কে সি দে সড়কে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন দোকান সাজিয়ে বিকিকিনিও শুরু করে দিয়েছেন। স্বল্পসংখ্যক হলেও ক্রেতার আনাগোনাও চোখে পড়েছে।
মেলায় এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এসেছে মাটির তৈরি সরঞ্জাম। মাটির তৈরি ঘর সাজানোর বিভিন্ন ধরনের আসবাব, সৌখিন জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা পুতুল, টাট্টু ঘোড়া নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ঝাড়ু, হাতপাখাসহ দু’য়েকটি গৃহস্থালি সামগ্রীর দোকানও দেখা গেছে। কাঠের তৈরি খাট, আলমিরা, আলনাসহ আরও নানা আসবাবপত্র নিয়েও বসেছেন কয়েকজন দোকানি।
জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যশোর-কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিছু কিছু বিক্রেতা এসেছেন। আজ (শনিবার) রাতের মধ্যেই সবাই এসে যাবেন। কাল (রোববার) সকাল থেকে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হবে।’
মেলায় ঘুরতে যাওয়া মেমন গ্রামার স্কুলের শিক্ষিকা রনি বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুইবছর পর মেলা হচ্ছে। ছোটবেলা থেকে এই মেলা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। আমরা সারাবছর মেলার অপেক্ষায় থাকতাম। গত দুই বছর করোনার কারণে হতে পারেনি। এবার মেলা হচ্ছে, সেজন্য খুব ভালো লাগছে।’
সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী নুর ই হাসনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাটির শো পিসগুলো দেখলাম। উনারা এত সুন্দরভাবে তৈরি করেন, সেগুলোর অন্যরকম আকর্ষণ আছে। সেগুলোই কিনব। আজ দেখে গেলাম। মেলা পুরোপুরি শুরু হলে আরও অনেকগুলো আসবে। তখন কিনব।’
মেলায় শরবতের দোকান খোলার আয়োজন করছিলেন হাজারী লেইনের বাসিন্দা আশীষ মহাজন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গৃহস্থালি সামগ্রী, ফুলের টব, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র তো থাকেই, গত কয়েকবছর ধরে দেখছি ফুলগাছের চারা, ফলজ গাছের চারা বেশি বিক্রি হয়েছে। ছাদবাগানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। হাটহাজারী-সাতকানিয়া, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছের চারা নিয়ে আসেন বিক্রেতারা।’
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর কুস্তির প্রবর্তন করেছিলেন যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘বলিখেলা’ নামে পরিচিত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলিখেলার সূচনা করেন তিনি। সূচনার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলিখেলা। বলিখেলার একদিন আগে-পরে তিনদিন ধরে লালদিঘীর পাড়সহ আশপাশের এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বসে মেলা। এ মেলায় গৃহস্থালী পণ্য থেকে শুরু করে নানা পণ্যের পসরা বসে।
করোনার সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর বলিখেলা ও মেলা হতে পারেনি। এবার মেলার ১১৩ তম আসর হওয়ার কথা থাকলেও বলিখেলার ভেন্যু লালদিঘী মাঠ সংস্কারের কারণে বন্ধ থাকায় এ আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আয়োজকরা বলিখেলা ও মেলা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলিখেলা ও মেলার আয়োজন করেন।
চসিকের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, লালদিঘীর মাঠ বন্ধ থাকায় ১২ বৈশাখ অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল সোমবার বিকেল তিনটায় লালদিঘীর পাড়ের গোলচত্বরে সড়কে বলিখেলা অনুষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর মেলার উদ্বোধন করবেন। মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এতে প্রধান অতিথি থাকবেন।
রোববার ভোর থেকে শুরু হওয়া বৈশাখী মেলা চলবে বুধবার ভোর পর্যন্ত। প্রতিবছর পাঁচদিন মেলার আয়োজন হলেও এবার রমজানের কারণে সময় দুইদিন কমানো হয়েছে।
এদিকে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সড়কে বলিখেলা ও বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে যানজটের আশঙ্কা করছে নগর পুলিশ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘বলিখেলা এবং মেলার কারণে যানবাহনের চাপ বাড়বে অবশ্যই। মেলাটা না হলেই ভালো হত। কিন্তু এটা ঐতিহাসিক একটা মেলা, বন্ধ হওয়াও সমীচীন নয়। আমরা নিরুৎসাহিত করছি না। তবে রমজানের কারণে যানজটটা যাতে না হয়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মেলা কমিটিকে বলেছি যে, সড়কের একপাশে দোকান বসাতে হবে। আরেকপাশ গাড়ি চলাচলের জন্য খালি রাখতে হবে।’
কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী জানিয়েছেন, সড়কের একপাশেই দোকান বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে বকশিরহাট বিট-লালদিঘীর পাড় হয়ে কোতোয়ালীর মোড় পর্যন্ত এলাকায় দোকান বসবে। লালদিঘীর পাড় থেকে জেল রোড হয়ে আমানত শাহ মাজার এবং লালদিঘীর পাড়ে জেলা পরিষদ চত্বরের সামনে থেকে হকার্স মার্কেট-নবী মার্কেট হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত দোকান বসানো হচ্ছে। লালদিঘীর পাড় সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে কে সি দে সড়ক হয়ে সিনেমা প্যালেস চত্বর থেকে বোস ব্রাদার্স পর্যন্ত দোকান বসবে।
যানবাহনের চাপ সামলানে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে কয়েকটি দ্বিমুখী সড়কের একপাশ পুরোপুরি যানবাহনমুক্ত রাখার ঘোষণা এসেছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নগরীর আন্দরকিল্লা মোড় (জামে মসজিদের সামনে) থেকে বকশির হাট-লালদিঘী অভিমুখী সড়ক, জেলা পরিষদ মার্কেট থেকে টেরিবাজার-আন্দরকিল্লা অভিমুখী সড়ক, সিনেমা প্যালেস থেকে কে সি দে রোড হয়ে সোনালী ব্যাংক পর্যন্ত সড়ক, জহুর হকার্স-মহল মার্কেট থেকে বাটা ক্রসিং পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়া টেরিবাজারে ফুলের দোকান থেকে টেরিবাজার এবং আমানত শাহ মাজার সড়কের মুখ থেকে টেরিবাজার পর্যন্ত সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
তবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যেসব গাড়ি প্রবেশ করবে ও বের হবে সেগুলো পুলিশের সহায়তায় চলাচল করবে। নগরীর টেরিবাজার, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, চাক্তাই অভিমুখী সড়কে সব ধরনের পণ্যবাহী গাড়ি ও বড় গাড়ি রাজাখালী দিয়ে প্রবেশ করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে বের হবে।
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরডি/একে