হুজুর বেশি অত্যাচার করে— বলার একদিন পরেই মৃত্যু
৮ মার্চ ২০২২ ১৭:৩১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে মাদরাসার ভেতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া ছাত্রটিকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। ছাত্রের বাবা অভিযোগ করেছেন, ‘চকরিয়া হুজুর’ নামে পরিচিত মাদরাসার এক শিক্ষকের নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল বলে তার ছেলে মৃত্যুর একদিন আগে জানিয়েছিল। তবে পুলিশের ধারণা, মাদরাসার ভেতরে একটি ভবনের ছাদ থেকে পড়ে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানার পিলখানা এলাকায় ‘আলী বিন আবী তালিব’ মাদরাসার ভেতর থেকে ওই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত মো. আরমান হোসেন (১৪) নগরীর মুরাদপুর মির্জারপুল এলাকার আব্দুল হামিদ সড়কের সর্দার বাড়ির ছেলে। তার বাবা মো. আব্বাস সবজি ও মুরগির ব্যবসা করেন।
আব্বাস সারাবাংলাকে জানান, গতকাল সোমবার বিকেল ৫টা থেকে তার ছেলে নিখোঁজ ছিল। মাদরাসার লোকজন খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাকে ফোন দেন। আরমান বাসায় গেছে কি না সেটি জানতে চান। এরপর রাতভর আব্বাস বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় ছেলেকে খোঁজাখুঁজি করেন। পরে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাদরাসা থেকে আবারও ফোন করে তাকে যেতে বলা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘সকালে ফোন করে আমাকে বলে, আপনি কি আরমানের আব্বা? আমার রাগ উঠে যায়। সারারাত ছেলেকে খুঁজেছি। সকালে আবার জিজ্ঞেস করছে আমি আরমানের আব্বা কি না। বলে, তাড়াতাড়ি মাদরাসায় আসেন। আমি মাদরাসায় যাই। গিয়ে দেখি, আমার বুকের ধন পড়ে আছে। পুলিশ তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে আব্বাস বলেন, ‘আমরা ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরশুদিন (রোববার) আরমান বাসায় এসেছিল। যাবার সময় আমাকে বলে, আব্বু, আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দেন। আমি বললাম, টাকা কেন? বলে— সিঙ্গারা খাব। আমি বললাম- তোমাকে মাদরাসায় নাস্তা দেয় না? তারা তো চার হাজার টাকা করে নেয়। এরপর আমার ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে- আব্বু, চকরিয়া হুজুর বেশি অত্যাচার করে, সবসময় মারধর করে। এটাই শেষ কথা। ছেলের সঙ্গে আর দেখা হল না। আমার বুকের ধনটাকে তারা মেরে ফেলেছে।’
তারেক হুজুর নামে পরিচিত মাদরাসার এক শিক্ষকের মাধ্যমে আরমানকে সেখানে ভর্তি করেছিলেন তার বাবা। তিনি জানান, চকরিয়া হুজুর নামে পরিচিত শিক্ষক মো. শোয়েবের অত্যাচারের কথা তিনি তারেককে জানিয়েছিলেন। তারেক বলেছিলেন— পড়ালেখা না করার জন্য আরমান ভান করছে।
আব্বাস আরও বলেন, ‘আমরা ছেলে আতুরার ডিপোর একটি মাদরাসা থেকে হাফেজ হয়ে বের হয়েছে। সামনের রমজানের তারাবারি নামাজটা যাতে সে ভালোভাবে পড়াতে পারে, আরও প্রশিক্ষণের জন্য তাকে আড়াই মাস আগে তারেক হুজুরের তত্ত্বাবধানে মাদরাসায় পাঠিয়েছিলাম। ছেলে যখন মারধরের কথা বলল, ভেবেছিলাম সামনে তো রমজান। বেশি দেরি নেই। তখন ছেলেকে একেবারে নিয়ে আসব। কিন্তু তারা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে, ভাবতে পারিনি। আমার একটাই সন্তান। আমি এখন কি নিয়ে থাকব?’
খুনের অভিযোগ কেন— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছি। গতকাল সোমবার বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে আরমানকে মাদরাসার একটি ভবনের ছাদে উঠতে দেখা গেছে। মাদরাসার লোকজন বলছেন, খেলা করার জন্য উঠেছে। অথচ সেখানে খেলার কোনো সুযোগই নেই। ছাদে ওঠার পর আর কিছুই সিসি ক্যামেরার ফুটেজে নাই। আমার ছেলেকে ছাদে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এটার তদন্ত হোক।’
জানতে চাইলে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেটি মাদরাসার ছাদে উঠেছে সেটা ঠিক। সেটা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আছে। কিন্তু সে আবার নেমে আসার কোনো ফুটেজ আমরা পাইনি। ছেলেটি মাদরাসার ছাদ থেকে পড়ে যাবার কিংবা কেউ তাকে ফেলে দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণও ফুটেজে পাইনি। ওই ভবনের সংলগ্ন মাদরাসার সীমানা দেয়ালের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয় সংশ্লিষ্টরা।’
হত্যাকাণ্ডের নিশ্চিত কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি জানিয়ে ওসি বলেন, ‘ভিকটিমের পরিবার আবেগের বশবর্তী হয়ে অভিযোগ করবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য বের করতে হবে। ফুটেজ পর্যালোচনা করেছি। শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আরও যারা সহপাঠী আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। মাদরাসার ছাদ আছে কিন্তু কোনো রেলিং নেই। ছাদটাও অনেকটা ফলস ছাদের মতো। সেখান থেকে অসতর্কতাবশত পড়ে যাবার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে। প্রকৃত ঘটনা বের করার চেষ্টা করছি। এখানে কিছুই অতিরঞ্জিত করা হবে না। অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না।’
এ ঘটনায় আব্বাস বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ওসি জাহেদুল কবীর।
তবে অভিযোগের বিষয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
সারাবাংলা/আরডি/এনএস
আলী বিন আবী তালিব মাদরাসা চট্টগ্রাম টপ নিউজ মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যু