Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেলার ‘সেই কোণে’ এক চিলতে ৭ ই মার্চ

আসাদ জামান
৭ মার্চ ২০২২ ২৩:০০ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০২২ ০৯:৪৩

অতীত সব সময় মধুর। অথবা যা কিছু সুন্দর, তা দ্রুতই অতীত হয়ে যায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা যখন একাডেমি প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ ছিল, মেলায় ঢুকতে যখন গলদঘর্ম হতে হতো, ধূলায় ধূসর মেলায় যখন নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্ট হতো খুব, মানুষের চাপে-ভিড়ে-ধাক্কা-গুতায় পরাণটা যখন হাঁসফাঁস করত, তখন ঘোষণা মঞ্চ থেকে ভেসে আসা কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তিগুলো হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দিত।

‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে/ আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো, আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো/ এই সংগীত-মুখরিত গগনে তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো/’ অথবা ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সংগীতে যত আছে/ হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে/ আকাশে মেলিয়া আঁখি তবুও ফুটেছে জবা/ দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে’ অথবা ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত/ শান-বাঁধানো ফুটপাথে পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে/ ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্মলেন্দু গ‍ুণ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এসব ফাগুন দিনের কবিতা ঘোষণা মঞ্চ থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসত। হৃদয় হরণ করা আবৃত্তিতে দূর হতো সব ক্লান্তি।

বিজ্ঞাপন

এমন কিছুর প্রত্যাশা থেকেই সোমবার (৭ মার্চ) অমর একুশে বইমেলার ২১তম দিন একটু আগে-ভাগেই মেলায় ঢুকছিলাম । বিকেল পৌনে ৩টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশের সময় এক পুলিশ সদস্য বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘স্যার কোথায় যাবেন? আজ মেলা শুরু ৩টায়।’ বললাম, ‘বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগে যাব’। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে যান’।

বলতে দ্বিধা নেই— পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে সচারাচার এমন আচরণ পাওয়া যায় না। তার এই বিনয়, সুন্দর আচরণে মগ্ধ হলাম। যেতে যেতে পেছন ফিরে আরেকবার দেখে নিলাম বিনয়ী ওই পুলিশ সদ্যকে। শুনেছি— ভালো মানুষের দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালে পাপ মোচন হয়!

বিজ্ঞাপন

প্রতিদিনের মতো আজও মেলার মূল মঞ্চে ঢুঁ মারলাম। উদ্দেশ্য— আজকের প্রোগ্রাম শিডিউলটা দেখে নেওয়া। প্রত্যাশিতভাবেই সেখানকার ইলেকট্রিক ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা— ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: বহুমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা সভা, যেটি শুরু হবে বিকেল ৪টায়। এতে স্বাগত ভাষণ দেবেন মুহম্মদ নুরুল হুদা, প্রবন্ধ পাঠ করবেন আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক। আলোচনায় অংশ নেবেন মো. নজরুল ইসলাম খান ও মনজুরুল আহসান বুলবুল। সভাপতিত্ব করবেন সেলিনা হোসেন।

আলোচনা শুরু হতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। মূল মঞ্চে পর্দা পড়ে আছে। মঞ্চের সামনে বসে আছে কয়েক প্ল্যাটুন পুলিশ, ফাল্গুনের গরমে ক্লান্ত-শ্রান্ত কয়েকজন দর্শনার্থী।

ঘড়ির কাটা ৩টার ঘর স্পর্শ করা মাত্র ঘোষণা মঞ্চ থেকে ভেসে এলো— ‘আজ ৭ মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ২২শে ফাল্গুন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। অমর একুশে বইমেলার ঘোষণা মঞ্চের কাজ শুরু হচ্ছে এখন। আজ বইমেলা শুরু বিকেল ৩টায়, শেষ হবে রাত ৯টায়…।’

ভেবেছিলাম, আজ ৭ মার্চ বলে মেলার ঘোষণা মঞ্চ থেকে দরাজ কণ্ঠে ভেসে আসবে— “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: কখন আসবে কবি/ এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না/ এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না/ এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না/ তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি/ তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি/… শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’/ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।”

কিন্তু না, ভেসে এলো না কোনো দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি। আজকের এই দিনে দেশব্যাপী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনা গেলেও মেলায় সেটি শোনা গেল না। মোটের ওপর কথা এই— ৭ মার্চের কোনো আবহই খুঁজে পাওয়া গেল না অমর একুশে বইমেলায়।

বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলাপ হলো বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কবি পিয়াস মজিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আগে যারা ছিলেন, তারা ঘোষণা মঞ্চ থেকেই প্রাসঙ্গিক কবিতার অংশ বিশেষ আবৃত্তি করতেন। এখন যারা আছেন, তারাও এ কাজে দক্ষ (ক্যাপাবল)। কিন্তু কেন করছেন না, সেটি তারাই বলতে পারবেন। আপনি চাইলে আপনার এই কনসেপ্ট তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ওখানে এখন দায়িত্ব পালন করছেন আবিদ করীম। তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে বেরিয়ে মেলার সোরাওয়ার্দী উদ্যানাংশের দিকে রওনা দিলে ড. মুহাম্মদ শহীদূল্লাহ ভবনের কোণা থেকে ভেসে এলো, ‘আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।’

‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’

মুহূর্তের মধ্যে শরীর ও মনে শিহরণ জেগে উঠল। যে ‘অমর কবিতাখানি’ নিয়ে এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সেটিই ভেসে আসছে পুকুরের পশ্চিম-উত্তর কোণ থেকে। মেলা উপলক্ষে যেখানে তৈরি করা হয়েছে ‘ভাষা শহিদ মুক্ত মঞ্চ’, যার আশপাশ দিয়ে যত্নহীন ভঙ্গিতে দাঁড় করে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তিমালার ডিসপ্লে বোর্ড। মেলার শুরু পর যেখানে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে জায়ান্ট স্ক্রিন টিভি মনিটর, সেখানেই আজ চালানো হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ।

পা আর সামনের দিকে গেল না, ফিরে গেল পেছনের দিকে। এক ঝাঁক মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ৭  মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ভিডিওচিত্র দেখে নিলাম। একই মঞ্চে ‘হাসুমণির পাঠশালা’র অংশগ্রহণে কবিতা-গান, নুরুল আমিন আতিক পরিচালিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিল।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ভাষণ শোনার পর বাকি আয়োজনে আর মন বসানো গেল না। বিকেল তখন ৪টা। বাংলা একাডেমির আঙিনা ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার আগে মেলার মূল মঞ্চে আরেকবার ঢুঁ মারলাম। কিন্তু তখনো শুরু হয়নি ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: বহুমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা সভাটি। ঘোষণা মঞ্চ থেকেও ভেসে আসছে না এ সংক্রান্ত কোনো কথামালা।

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

টপ নিউজ বইমেলা বইমেলা ২০২২ বইমেলায় ৭ মার্চ

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর