Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুণবীর ‘ওয়াজ শুনে’ জঙ্গিবাদে জড়ান বইমেলা থেকে গ্রেফতার রুমেল

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৫৬ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:১৮

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে একুশের বইমেলায় ‘হামলা করতে গিয়ে’ গ্রেফতার তরুণ রুমেল ‘বিতর্কিত’ ধর্মীয় বক্তা মাহমুদুল হাসান গুনবীর ওয়াজ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন বলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

ফেসবুকে ‘উম্মাহ নেটওয়ার্ক’ নামে একটি পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে উগ্রবাদী প্রচারণা দেখেও তার মধ্যে পরিবর্তন আসে। উম্মাহ’র বিভিন্ন পোস্টে রুমেল মন্তব্য করতেন এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

বিজ্ঞাপন

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, অপ্রচলিত টেলিগ্রাম অ্যাপসের মাধ্যমে রুমেলসহ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। হামলার লক্ষ্য নিয়ে বইমেলায় যাওয়ার আগে টেলিগ্রামে মেসেজ দিয়েছিলেন রুমেল।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ‍উপকমিশনার আহমেদ পেয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘রুমেলকে আটকের পর আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা মোবাইল ব্যবহার করে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের কিছু প্রমাণ পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদে সে মাহমুদুল হাসান গুণবীর ধর্মীয় ওয়াজ শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে।’

আরও পড়ুন- “‘তাগুত’দের বইমেলায় হামলা করতে গিয়েছিলেন আনসার আল ইসলামের রুমেল”

গত সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণে সিটি করপোরেশন আয়োজিত বইমেলা থেকে রুমেলকে আটক করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে সংস্থার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে নগরীর কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করেন।

বিজ্ঞাপন

গ্রেফতার মো. রুমেল (২০) নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের কুদ্দুস মিয়ার ছেলে। তবে বর্তমানে রুমেল চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার বড়বাড়ি এলাকায় থাকতেন।

রুমেলকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসএসসি পাস করে ২০২০ সালে রুমেল নরসিংদী থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে মামার কাছে আসেন। মামা নগরীর চান্দগাঁও এলাকার বিডি ওয়েল মাস্ক ফ্যাকটরিতে চাকরি করেন। রুমেলও সেখানে চাকরি নেন এবং রাতে কারখানায় থাকতেন।

গত নভেম্বর থেকে রুমেলের মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে। বেশভূষা, আচার-আচরণ পাল্টে যায়। এর আগেই তিনি উম্মাহ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হন। পরিবর্তনের বিষয়টি ফেসবুকে নিজেই জানান দেন রুমেল।

আরও পড়ুন- চট্টগ্রামে বইমেলা থেকে ২ যুবক আটক

গত ২৩ জানুয়ারি নিজের কয়েকটি ছবি দিয়ে ফেসবুক পোস্টে রুমেল লেখেন— ‘আল্লাহ তায়ালা কাউকে হেদায়েত দান করলে কেউ তাকে ধরে রাখতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানি, আমি নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করেছি। তিন বছর আগের ছবি আর তিন বছর পরের ছবি দু’টোই দেওয়া আছে। এখানে কতটা খারাপ ছিলাম আমি আর আল্লাহ কতটাই না ভালো করেছে আমাকে। সবাই দোয়া করবেন আমি যেন ইসলামের প্রতি সর্বদায় থাকতে পারি সঠিক ও সত্যের সন্ধানে থাকতে পারি।’

এরপর ২৫ জানুয়ারি রুমেল ‘জিহাদি বক্তব্যসম্বলিত’ একটি ভিডিও আপলোড করেন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। ৫ ফেব্রুয়ারি আরেক পোস্টে কাশ্মিরে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতীকী ছবি পোস্ট করে জিহাদের পক্ষে বক্তব্য দেন রুমেল। একই দিন নিজের কাভার ছবিতে মাহমুদুল হাসান গুণবীর ছবি পোস্ট করে লেখেন ‘উত্তম আদর্শ’। ৬ ফেব্রুয়ারি মামুনুল হকের দু’টি ভিডিও শেয়ার দিয়ে লেখেন ‘বাঘের বাচ্চা’।

৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক থেকে বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে লেখেন, ‘সবাই দোয়া করবেন আমার জন্য, আমি আর ফেসবুক চালাব না।’ এরপর থেকে রুমেলের আর কোনো ফেসবুক পোস্ট পাওয়া যায়নি।

রুমেলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘উম্মাহ নেটওয়ার্কের ফেসবুক পেজ ও তাদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন বক্তব্যে রুমেল প্রভাবিত হয়। মাহমুদুল হাসান গুণবীর ওয়াজ শুনে সে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়। হেফাজতের সাবেক নেতা মামুনুল হকের বক্তব্যও তার মধ্যে প্রভাব ফেলে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে উগ্রবাদী আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। উম্মাহ নেটওয়ার্কের পোস্টে বিভিন্ন উগ্র মন্তব্য করতে থাকে। এর মধ্যে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। সংগঠনটির পক্ষ থেকেই তার সঙ্গে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করা হয়।’

মাহমুদুল হাসান ‍গুনবী আনসার আল ইসলামের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে পরিচিত। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হক ২০২১ সালের ২৬ মার্চ মোদীবিরোধী সংঘাতের পর গ্রেফতার হন। এর আগে অবশ্য তিনি ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আনসার আল ইসলামের সংগঠকদের সঙ্গে রুমেলের যোগাযোগ হতো টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে টেলিগ্রামের গ্রুপে ক্ষুদেবার্তা দিয়ে রুমেল বইমেলায় যান। টেলিগ্রামে লেখেন, ‘আমি চট্টগ্রামের বইমেলায় হামলা ও আক্রমণ করতে যাচ্ছি, চট্টগ্রামের কোনো ভাই থাকলে আমাকে জানান।’ একই গ্রুপে যুক্ত থাকা কয়েকজন তার কাছে হামলার বিস্তারিত পরিকল্পনা জানতে চান।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্তে রুমেল বইমেলায় হামলা করতে গিয়েছিল— এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদে সে নিজেও এটা বলেনি। ‍উগ্রবাদী চিন্তা থেকে সে নিজে নিজেই পরিকল্পনা নিয়ে হামলা করতে গিয়েছিল।’

নগরীর কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮, ৯ (৩), ১১ ও ১৩ ধারায় রুমেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুমেল জানিয়েছে— একুশে ফেব্রুয়ারি পালন হলো খাম্বা ও পিলার পূজা করা। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যারা বইমেলার আয়োজন করেছে, তারা তাগুত অর্থাৎ সীমা লঙ্ঘনকারী। তাগুতদের আয়োজিত বইমেলায় হামলার উদ্দেশে সে এসেছিল। আরও কয়েকজন সহযোগী তার সঙ্গে এই হামলায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল।

তাদের আরও লক্ষ্য হচ্ছে আনসার আল ইসলামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে শরিয়াহ ও খিলাফতভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। অপ্রচলিত অ্যাপস ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে সংগঠনের সব তথ্য আদান-প্রদান করে।

এদিকে, গ্রেফতার রুমেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির তদন্তভার নিয়েছে পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। তদন্তকারী কর্মকর্তা এটিইউ’র পরিদর্শক খায়রুল ইসলাম তালুকদার গ্রেফতার রুমেলকে বুধবার দুপুরে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।

পুলিশ পরিদর্শক খায়রুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সাত দিনের আবেদন করেছিলাম। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাকে চট্টগ্রামে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

জঙ্গি টপ নিউজ বইমেলায় হামলা মো. রুমেল সিটিটিসি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর