মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
১২ এপ্রিল ২০১৮ ২১:০১ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:১১
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
ঢাকা: শুদ্ধতার বার্তা নিয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাঙালির ঐতিহ্যের উৎসব বাংলা বর্ষবরণ। বাঙালির সার্বজনীন এ উৎসবকে বরণ করতে প্রস্তুত রাজধানী ঢাকা। শহরের সাজ-সজ্জা আর বিপনী বিতানগুলোয় মানুষের কেনাকাটা সে কথাই বলছে।
বৈশাখের আয়োজন জোরেশোরে চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে। বিল্ডিং এর নিচে, গ্যালারিতে, মাঠে-ঘাসে, সবখানেই প্রস্তুতি ছাপ বেশ চোখে পড়ে। বানানো হচ্ছে বড় বড় ভাস্কর্য, মুখোশ, নানান মাপের পাখি আর পেঁচা। দিনের প্রথম প্রহরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় এগুলোই শোভা বাড়াবে।
https://youtu.be/boBgStucagU
মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুধু বৈশাখ উৎসব উদযাপনে সীমাবদ্ধ নয়। এই আয়োজনের শেকড় আরও গভীর, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, ‘আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।’ মঙ্গল শোভাযাত্রা সকল পুরাতন অশুভকে সরিয়ে মঙ্গলের ডাক দেওয়ার জন্য।
এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। শুধু লালনের বিখ্যাত উক্তিকে সামনে রেখে নয়, কাজেও তারা দিচ্ছেন লালনের মানসিকতার পরিচয়। চারুকলায় ঢুকতেই চোখে পড়বে ভাঙা গেট সংস্কার হচ্ছে, এই গেটগুলো চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনের বলি। কিছু নির্মাণাধীন ভাস্কর্য, অনেক টাকার বাঁশ পুড়েছে এই আন্দোলনের রোষে। কিন্তু সেই যে মানুষকে ভজন করা। তাই করে যাচ্ছেন এখানকার শিক্ষার্থী, শিক্ষকরা।
অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের প্রভাষক সুমন ওয়াহিদ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন ইন্সটিটিউটের লনের এক কোণায়, জয়নুল শিশুকলা নিকেতনের কুটিরটিতে। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা ভিতরে ঢুকে পরে, তারা খুব আতংকিত ছিল, এরপর দিকজ্ঞান শূন্য হয়ে আমাদের ভাস্কর্যের উপরে এসে পরে, ব্যাস…’ মিষ্টি হেসে এড়িয়ে যান সুমন।
জয়নুল গ্যালারি-১ এ চলছে বিশাল রাজা রাণীর মুখোশ বানানোর কাজ। এ মুখোশগুলো বানানো বেশ কষ্টসাধ্য, প্রথমে বিশাল মাটির ছাঁচ বানাতে হয়। সেই ছাঁচের উপরে কাগজের পরত দিয়ে দিয়ে তৈরি হয় মুখোশের মূল কাঠামো। সেই কাঠামো শুকিয়ে গেলে তা আলাদা করে রঙ করা হয়। রঙ আর সাজের পার্থক্য করে রাজা রাণীর ‘থিম’ নির্ধারিত হয়। কোনো রাজা রাণী হয় রিক্সা পেইন্ট, কেউ পায় টেরাকোটার প্রলেপ। কেউ আবার ফুলপাতার প্রকৃতির রূপ নেয়।
এই অংশটা দেখা-শোনার দায়িত্বে আছেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য। গ্যালারির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে শিক্ষার্থীরা, কেউ রঙ মিশাচ্ছে, কেউ তুলি বিলাচ্ছে, কেউ এক মনে রঙ করে যাচ্ছে। কাজের ফাকেই কেউ একজন গেয়ে উঠলে, তোমার, খোলা, হাওয়া, লাগিয়ে পালে… সারা গ্যালারি ময় গমগমিয়ে উঠলো সেই সুর, কাজের ফাঁকে ফাকেই গলা মিলানো শুরু করলো তার সতীর্থরা।
বছরের এই সময়টা চারুকলায় পা রাখার জায়গা থাকে না। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন, জানালেন মশিউর রহমান মিশু। ২০ তম ব্যাচের এই ছাত্র এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সহযোগী আহ্বায়ক। শুরু থেকেই তিনি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন পুরোটা এলাকা।
মিশু বললেন, সাধারণত আমাদের প্রতিদিনের বিক্রি হয় লাখ টাকারও উপরে, গত কদিন এলাকাটি আন্দোলন মুখর, চারদিকের পথ রুদ্ধ। এ অবস্থায় আদৌ আমরা খোলা আছি কি-না তাও জানেন না অনেকেই।
জয়নুল গ্যালারি-২ এ চলছে পেঁচা আর বাঘের মুখোশ বানানোর কাজ। এখানেও যথারীতি রঙ আর তুলির মাখামাখি অবস্থা, মুখ তুলে যে কেউ তাকাবেন সে উপায় নেই। বিভিন্ন পত্রিকা, চ্যানেল থেকে আসা সাংবাদিকরা ছবি তুলছেন, এতেও ধ্যান ভাঙছে না কোনো শিল্পীর।
ঘাসের মধ্যের ছোট্ট কুটির জয়নুল শিশুকলা নিকেতন। এখানে মূলত বাইরের শিশুদের ছবি আঁকা শেখায় চারুকলার ছাত্ররা, সেরকম দুই একজন শিশুও জুটে গেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজে। আছে পথশিশুরাও কেউ কেউ। তাদের একমাত্র লোভ কাজ করলে থালা ভরে ভাত খাওয়া যাবে।
একই থালায় পাশাপাশি বসে ভাত খাচ্ছেন একজন শিল্পী এবং একজন পথশিশু। মানুষ ভজার বিষয়টি এখানে নিছকই কথা নয়।
একদম শুরুর গেটে বসে আছে সরা শিল্পীরা দেওয়ালে টানানো অনেক অনেক পেইন্টিং, সরা, ছোট ছোট কাগজের পাখি। এগুলো সব বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। এ বিক্রির টাকা থেকে আসবে মঙ্গল শোভাযাত্রার খরচ। নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা ছবিগুলোর শিল্পীরাই ভবিষ্যতে বিশাল দামে নিলামে উঠাবেন তাদের শিল্প কর্ম। এখানে আছে শিক্ষকদের আঁকা ছবিও। দাম সেই একই। সবার কাজের মূল্যই সমান, শুধু আকারের ভেদে কম আর বেশি।
বিশাল একটা ষাঁড়, একটা টেপা পুতুল আর প্রায় শেষ হয়ে আসা একটা হাতি। একপাশে পুড়ে যাওয়া একটা সূর্য আবার জ্বলে উঠার চেষ্টা করছে মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য। আর মাত্র একটি দিন। এরপরই তারা বেরিয়ে পড়বে নতুন বছরের মঙ্গলকে আমন্ত্রণ জানাতে।
সারাবাংলা/এমএ/এমএস