‘আফ্রিকার দস্যুদলে’র কৌশল শিখে ছিনতাইয়ে নেমে ধরা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৫৬ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শহরের চার ছিনতাইকারীর একটি চক্র। দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়ংকর অপরাধীদের দস্যুতা নিয়ে নির্মিত একটি সিনেমা ইউটিউবে দেখে তাদের অনুকরণ করে ছিনতাইয়ে নেমেছিল। প্রথমে যাত্রী বেশে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে ফিল্মি স্টাইলে সেটি ছিনতাই করে। সেই প্রাইভেট কারে গিয়ে একই স্টাইলে একটি ফার্মেসি থেকে টাকা লুট করে। এরপর পুরো শহরে ঘুরে ঘুরে আরও অন্তত ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ তাদের গ্রেফতার করে। উদ্ধার করে তাদের ছিনতাই করা প্রাইভেট কারটিও।
গ্রেফতার চার জন হলেন— বেলাল হোসেন আসলাম (২৭), তানভীর ইসলাম রোকন (২৭), মো. সোহেল (৩০) এবং কামাল উদ্দিন মহিউদ্দীন (২৮)।
পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতার চার জনের একজন ‘গডফাদার’ আছে। মাসুদ আলম হিরো (২৮) নামে ওই দলনেতাও পেশাদার অপরাধী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাব রাখেন। তার বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলায়। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতির অভিযোগে চারটি মামলার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টাও করছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সিনেমায় গাড়ি ছিনতাই করে সেই গাড়ি ব্যবহার করে ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে ডাকাতির কৌশল দেখানো হয়। ইউটিউবে সেই সিনেমা দেখে তারা ছিনতাইয়ের কৌশল শেখে এবং পরিকল্পনা করে। এর আগে তারা এমনিতে রাস্তায় পথচারী বা রিকশাযাত্রীকে ছোরার ভয় দেখিয়ে ছিনতাই করলেও এবার তারা ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাইয়ে নামে। পুরো মহানগর থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ঘুরে কমপক্ষে ১২টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। কেউ যদি বাধা দিত, তবে তাকে খুন করার মতো প্রস্তুতিও তাদের ছিল।’
গত শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় একটি প্রাইভেট কারের চালককে জিম্মি করে তারা গাড়িটি ছিনতাই করে। বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রাইভেট কারটির সবশেষ মালিকানা ছিল এক সরকারি কর্মকর্তার।
ছিনতাইয়ের বর্ণনা দিয়ে গাড়িচালক মো. ইলিয়াছ সারাবাংলাকে জানান, শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে নগরীর অলংকার মোড় থেকে তিন জন মিলে সীতাকুণ্ডের দোয়াজিপাড়া যাবার জন্য ৭০০ টাকায় কারটি ভাড়া করে। পথে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে একজন আইনজীবী উঠবেন বলে তারা জানান। ইলিয়াছ গাড়ি বাঁশবাড়িয়া নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করায়।
‘আমি গাড়ি দাঁড় করানোর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে একজন আমার ঘাড়ে আঘাত করে। আমাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে পেছনের সিটে নিয়ে একজন ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি চালানো শুরু করে। পেছনের সিটে তিন জন আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। মালিককে দুই লাখ টাকা পাঠাতে বলার জন্য এবং আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। আমি আমার আব্বাকে ফোন করে টাকা পাঠাতে বলি। ততক্ষণে তারা আমার নগদ ও বিকাশ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর নিয়ে ফেলে। গাড়ি ইউটার্ন করে ফৌজদারহাট দিয়ে বায়েজিদ লিংক রোডে ঢুকে রাত ৮টার দিকে আমাকে মারধর করে নামিয়ে দেয়। আমি রাতেই ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে অভিযোগ করি। পরদিন সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করি,’— বলেন ইলিয়াছ।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আজহারুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, গ্রেফতার আসলাম প্রথমে ইউটিউবে আফ্রিকার ভিডিওটি দেখে। এরপর সে তাদের দলের আরও তিন জনকে দেখায়। চার জন মিলে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। এর দুই দিন পর তারা গাড়ি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা নিয়ে অলংকার মোড়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর আসলাম তিন জনকে রেখে একা সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া চলে যায়।
বাকি তিনজন প্রাইভেট কার ভাড়া করে সেখানে যাওয়ার পর আসলাম এক কেজি আপেল ওঠানোর অভিনয় করে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সোহেল চালকের ঘাড়ে আঘাত করে এবং তারা ছিনতাইকারী বলে জানিয়ে দেয়। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেটি শহরের লিংক রোডে এনে চালকের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাকে নামিয়ে দেয়। পরে তারা ওই প্রাইভেট কার নিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলায় মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে চলে যায়।
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে গ্রেফতার তানভীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল গাড়ি ছিনতাই করব। প্রথম কাজ সফল হওয়ায় আমরা মাইজভাণ্ডার শরীফ জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম।’
এসআই আজহার আরও জানান, ফটিকছড়ি থেকে ফিরে তারা ওই প্রাইভেট কারে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করে। ভোর সাড়ে ৩টার দিকে তারা বায়েজিদ বোস্তামি থানার অক্সিজেন কাঁচাবাজার এলাকার গিয়ে হাফছা হানিফ মেডিসিন ওশান নামে একটি ফার্মেসি খোলা পেয়ে সেখানে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ৭০ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন ও একটি ট্যাব ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়।
ফার্মেসিতে ডাকাতি শেষে রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরের দিকে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় গিয়ে এক রিকশা যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর প্রাইভেট কারটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে তারা আশপাশে অবস্থান নেয় এবং সেটি কেউ নিতে আসছে কি না, সেটি নজরদারি শুরু করে।
ওইদিন (রোববার) রাত ১০টার পর আবারও সেই গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ঘুরতে বের হয়। রাতভর ঘুরে ঘুরে অন্তত ৯টি স্থানে তারা ছিনতাই করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসআই আজহার জানান।
এদিকে, ফার্মেসিতে ফিল্মি কায়দায় লুটপাটের অভিযোগ পেয়েই জড়িতদের শনাক্তের কার্যক্রম শুরু করে বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ, গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া, জড়িতদের শনাক্ত করা, প্রাইভেট কারের সন্ধানে তৎপরতা মিলিয়ে টানা চার দিন অভিযানের পর তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
বায়েজিদ বোস্তামি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুরুতেই আমরা ফার্মেসির সামনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে প্রাইভেট কারের নম্বর শনাক্ত করি। কিন্তু সেটির মালিক শনাক্ত করতে গিয়ে আমাদের বিপত্তিতে পড়তে হয়। গাড়িটি ছয় বার হাতবদল হয়েছে। সবশেষ যার নামে গাড়ির নথিপত্র আছে, তিনি সাবেক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। তিনি আছেন সুইজারল্যান্ডে। কিন্তু তিনিও গাড়িটি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা তথ্য পাই, সীতাকুণ্ড থানায় একটি প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পাওয়া গাড়ির নম্বর ও মামলায় দেওয়া গাড়ির নম্বর একই পাওয়া যায়। সেখান থেকে আমরা গাড়ির মালিক ও চালককে শনাক্ত করি।’
‘ফার্মেসিতে লুটের ঘটনায় চার জন জড়িত বলে আমরা নিশ্চিত হই। তবে তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তখন আমরা আরেক কৌশল নিই। যেহেতু দুই দিন তারা রাতে প্রাইভেট কার নিয়ে চুরি করতে বের হয়েছে, আমরা ধরে নিই লিংক রোড ধরে তারা আবারও একই উদ্দেশে যেতে পারে। তাৎক্ষণিক চেকপোস্ট চালুর প্রস্তুতি নিয়ে লিংক রোডে অপেক্ষা করতে থাকি। অবশেষে রাত ১০টার দিকে প্রাইভেট কারটি আসতে দেখে চেকপোস্ট বসিয়ে সেটি আটক করি। ভেতরে চার জনকে পাওয়া যায়,’— বলেন ওসি কামরুজ্জামান।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর