১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা
২৬ জানুয়ারি ২০২২ ১০:৫৭ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:৪১
ছয় দিন পেরিয়ে সপ্তম দিনও পূরণের পথে। এর মধ্যে বাধা এসেছে, হুমকি এসেছে, এসেছে নানা ধরনের আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অটল ছিলেন ২৮ শিক্ষার্থী, চালিয়ে যাচ্ছিলেন আমরণ অনশন। দাবি পূরণ না হলেও শেষ পর্যন্ত পূরণের ‘নিশ্চিত আশ্বাস’ দিয়েছেন শাবিপ্রবির সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। প্রিয় শিক্ষকের অনুরোধ আর ফেলতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। ১৬৩ ঘণ্টা পর ভেঙেছেন অনশন।
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) ভোর চারটার দিকে স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হককে নিয়ে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে পৌঁছান ড. জাফর ইকবাল। ‘উচ্চ পর্যায়ে’ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দাবিপূরণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন বলে আশ্বস্ত করেন শিক্ষার্থীদের। সেই প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেই শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে রাজি করান। পরে সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে ড. জাফর ইকবালের হাতে পানি পান করে অনশন ভাঙেন ২৮ শিক্ষার্থী।
এর আগে, গত বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বিকেল তিনটায় অনশন শুরু করেন শাবিপ্রবির ২০ শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আরও আটজন। এই ২৮ জনের মধ্যে ২০ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও অনশন ভাঙেননি। আজ অষ্টম দিনের মাথায় এসে দাবিপূরণের প্রতিশ্রুতিতে অনশন ভাঙলেন তারা।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় ড. জাফর ইকবাল বলেন, আমি এখানে আসতে চাইছিলাম না। কারণ তোমরা আমরা কথা না শুনলে তাই! তবে আমার ছেলে-মেয়েদের ওপর আমার বিশ্বাস ছিল, তাই এসেছি। আমি সংকল্প করে এসেছি তোমাদের অনশন ভাঙিয়ে তারপর আমি সিলেট ছাড়বো। আমি চাই তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও, তবে অনশন ভেঙে আন্দোলন করো। আন্দোলন আর অনশন ভিন্ন জিনিস! আমি এসেছি তোমাদের অনশন ভাঙাতে।
এর আগে ভোরে ক্যাম্পাসে পৌঁছে শিক্ষার্থীদের হাতে নগদ অর্থসহায়তা তুলে দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, তোমাদের সাহায্য করলে যদি এরেস্ট হতে হয় হবো। আমি দেখতে চাই সিআইডি এসে আমাকে এরেস্ট করে কী না।
তিনি বলেন, সাবেক শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সহায়তা করতেই পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থে লেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়েছে। আমি এই সম্মানির টাকাটা আন্দোলনের ফান্ডে দিচ্ছি। এবার পারলে আমাকে অ্যারেস্ট করুক।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে জাফর ইকবাল বলেন, আমি যখন দুপুরে কথা বলছিলাম তখন ধরেই নিয়েছিলাম, এখানে যেহেতু এতগুলো মানুষ অনশন করছে, সেখানে একটা মেডিক্যাল টিম আছে। ডাক্তাররা কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখছেন, কী অবস্থা। এখানে এসে দেখলাম শুধু যে ডাক্তাররা নেই, তা না। যারা ছিল তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দূর করে দেওয়া হয়েছে। এর চাইতে বড় অমানবিক ব্যাপার আর কী হতে পারে।
এই ঘটনাকে শিক্ষার্থীদের হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, অলমোস্ট ছেলেদের মার্ডার করার একটা সুপরিকল্পনা ছিল। আমি শুনে খুবই দুঃখ পেলাম। আমারপক্ষে যেটুকু সম্ভব, আমি জানাবো উপর মহলকে।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্যাম্পাসের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম ওরা নিজেরা ক্যানোলা ঢুকিয়ে স্যালাইন দিচ্ছে। আমার মনে আশা ছিল, কন্টিনিউয়াসলি ঠিকভাবে স্যালাইন দেওয়া হয়, তাহলে ছেলেবেলেগুলা অন্তত স্ট্যাবল থাকবে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ওরা স্যালাইন আর নিতে পারছে না। ৮টা জায়গায়, ৯টা জায়গায় ক্যানোলা বসাতে হয়েছে। এখন ক্যানোলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে স্যালাইন দেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখানে যাদের দেখছি তাদের অবস্থায় যখন এতো খারাপ। তাহলে না জানি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা ওই ২০ জনের কী অবস্থা।
এই পরিস্থিতিকে সুপার মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি হিসেবে মন্তব্য করেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা শুয়ে আছে কন্টিনিউয়াসলি। ফুসফুসে পানি চলে আসছে। এটা সুপার মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। কিন্তু তাদের সাহায্য করা যাবে না। এর থেকে বড় মানবিক বিষয় হতে পারে না।
এ সময় জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াছমিন হক বলেন, শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জায়গা, রান্নার সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টং দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতো ছাত্র খাবে কোথা থেকে?
পরে জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভাঙতে রাজি হন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবিপূরণের আশ্বাস দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, উচ্চপর্যায়ে তার আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে দাবিপূরণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছেন। অনশন না ভাঙিয়ে তিনি ফিরে যাবেন না।
আরও পড়ুন-
- শাবিপ্রবিতে ফের মশাল মিছিল
- ‘উপাচার্য পদের মূল্য বেশি নাকি শিক্ষার্থীর প্রাণ’
- ভিসির বাসভবনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, শিক্ষক সমিতির নিন্দা
- শাবিপ্রবিতে অনশন থামিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত
- শাবিপ্রবি আন্দোনে অর্থ সহায়তার ‘অভিযোগে’ ৫ শিক্ষার্থী আটক
- ভিসির বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দিলো শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা
- ৬ষ্ঠ দিনে অনশন— সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেই শাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষের
- বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের ছয়টি মোবাইল নম্বর
এর আগে, গত ১৩ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের ছাত্রীরা।
পরে ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়। পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করলে তাদের উপর লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে পুলিশ। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। তা উপেক্ষা করেই উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলমান রাখেন শিক্ষার্থীরা। ১৯ জানুয়ারি দুপুর ২টা ৫০ মিনিট থেকে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন।
সারাবাংলা/এএম