অফিস তালা মেরে পালিয়েছেন লাকসুরার কর্মীরা, চেয়ারম্যানও আত্মগোপনে
১৪ জানুয়ারি ২০২২ ১৭:৪৪ | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:০৮
ঢাকা: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান লাকসুরা এন্টারপ্রাইজ মাত্র তিন মাসে শত শত গ্রাহকদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করেছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। বাজারের চেয়ে কম দামে মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রির নামে প্রতিষ্ঠানটি এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। গ্রাহকদের অভিযোগ ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো গ্রাহককে পাওনা পরিশোধের জন্য চেক দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। এমন অবস্থায় টাকা না পেয়ে দিশেহারা গ্রাহকরা।
এ নিয়ে গত ১০ জানুয়ারি সারাবাংলা ডটনেটে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: এবার গ্রাহকের ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও লাকসুরা!
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওইদিন সন্ধ্যায় লাকসুরার চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় লাকসুরার পেজে ফেসবুক লাইভে আসেন। ওই লাইভে তিনি জানান, তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য বিদেশে রয়েছে। তবে কোন দেশে রয়েছেন তা তিনি জানাননি। পাশাপাশি গ্রাহকদের টাকা কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া সে বিষয়েও স্পষ্ট কিছু বলেননি। বরং প্রকাশিত প্রতিবেদন মিথ্যা-বানোয়াট উল্লেখ করে সাংবাদিকদের গালমন্দ করেন।
ওই লাইভে লাকসুরার চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন আগামীকাল (১১ জানুয়ারি) থেকে অফিস খোলা থাকবে। ফেসবুকে ঘোষণা দিলেও আগের মতোই বন্ধ অবস্থায় রয়েছে লাকসুরার কার্যালয়।
লাকসুরার চেয়ারম্যান ফেসবুক লাইভে দাবি করেন— ৩০০ কোটি টাকা নয়। তিন মাসে ট্রানজেকশন হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। তার প্রতিষ্ঠানের দুঃসময় চলছে, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে এই অর্থ গ্রাহকদের ফেরত দেবেন।
তিনি আদম ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভিসা সংক্রান্ত কাজে একাধিকবার তাকে বিদেশে যেতে হয়। সুস্থ হলেই তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে ফেসবুক লাইভে উল্লেখ করেন।
অফিসে তালা, পালিয়েছেন কর্মকর্তারা: এদিকে সরেজমিনে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার লাকসুরার অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ রয়েছে। ওখানকার একজন কেয়ারটেকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাস দুয়েক হলো অফিসে লাকসুরার কেউ আসে না। শুধু ফোনে ফোনে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলেন বলে জানতে পেরেছি। ইচ্ছা হলে তারা ফোন ধরেন, না হলে ধরেন না।’
তিনি জানান, প্রতিদিনই পাওনা টাকার জন্য অফিসে গ্রাহকরা আসেন। টাকা না পেয়ে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
লাকসুরার গ্রাহক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমার টাকা চাই। কী হলো, না হলো আমি জানতে চাই না। ২০ তারিখের মধ্যে আমার টাকা চাই। তা না হলে আমার ব্যবস্থা আমি করব।’
আব্দুল্লাহ মামুন পালসার মোটরসাইকেল কেনার জন্য লাকসুরাকে ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখন টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
মাহবুব হাসান নামে একজন গ্রাহক বলেন, ‘আমি নগদ টাকা পেমেন্ট করেছি। সেই স্লিপ আমার কাছে আছে। কিন্তু আমি এখন কোনো টাকা ফেরত পাচ্ছি না। ভাবছি মামলা করব।’
রাজধানীর রামপুরা এলাকার এস এম সালমান নামে এক গ্রাহক গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি মোটরসাইকেল (পালসার এনএস ১৬০ এবিএস) অর্ডার করেন। দুই লাখ টাকার মোটরসাইকেল ধামাকা অফারে তিনি এক লাখ ৪১ হাজার ৭০০ টাকায় অর্ডার করেন। সেই অনুযায়ী তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর এক লাখ ৪২ হাজার টাকা ৩১, ডেল জননী, বনানী মডেল টাউনের অফিসে গিয়ে দিয়ে আসেন। তার পণ্যটি ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তিনি মোটরসাইকেলটি পাননি।
গ্রাহক সালমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘৪৫ দিন পার হওয়ার পর পণ্য না পেয়ে তাদের অফিসে গেলে টালবাহনা শুরু করে। পণ্য না পেয়ে টাকা দাবি করলেও তারা সেটা আমলে নিতে জায়নি। এক পর্যায়ে ৬০ দিনের মাথায় এক লাখ ৯৬ হাজার টাকার ব্রাক ব্যাংকের একটি চেক দেয় আমাকে। যেটি দিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে টাকা উত্তোলনের কথা বলা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার ব্যাংকে গিয়ে চেক জমা দিলেও ওই হিসাব থেকে কোনো টাকা পাওয়া যায়নি।’
সালমান বলেন, ‘ধামাকা অফার, ঝড়ো অফার দিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হাজার হাজার গ্রাহকের এসব টাকা নিয়ে এখন চেয়ারম্যান বিদেশে পালিয়ে আছেন। কারও টাকা দিচ্ছেন না। চেক দিয়েও প্রতারণায় মেতেছেন লাকসুরা এন্টারপ্রাইজ। প্রায় দিনই লাইভে এসে গ্রাহকদের অপেক্ষা করার জন্য নানাভাবে আবেগ-আপ্লুত করছেন। অথচ কর্তৃপক্ষ অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে আছেন।’
মো. জিয়া উদ্দিন নামে এক গ্রাহক অভিযোগ করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের টাকা নিয়ে জায়গা জমিতে ইনভেস্ট করছে। এখন টাকা দিতে পারছে না। দেশের বাইরে থেকে লাইভ করে সময় না চেয়ে টাকাটা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’ জাকির হোসেন নামে একজন লিখেছেন, মূল টাকা ফেরত দিয়ে দিন। লাইভ চাই না।’
গ্রাহকরা জানায়, মাঝে মধ্যে লাকসুরার প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন ফেসবুক লাইভে এসে টাকা পরিশোধের জন্য গ্রাহকদের কাছে সময় চান। আবার অনেক দিন এমন হয়েছে যে, লাইভে আসতে চেয়েও আসেননি। তবে সবশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানির ফেসবুক পেজে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন লাকসুরার চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
লাকসুরার অফিস তালাবদ্ধ কেন জানতে চাইলে লাকসুরার একজন নারী ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার বলেন, ‘আমরা আমাদের অফিস খুলিনি। কবে খুলব তাও বলতে পারছি না। অফিস খোলা হলে আপনারা জানতে পারবেন।’
গ্রাহকদের পাওনা টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা পাওনা দিয়ে দিয়েছি। আমাদের কাছে ডকুমেন্টস আছে। এ সব নিয়ে পরে কথা হবে। সময় হলেই বুঝতে পারবেন টাকা দেওয়া হয়েছে কি না?’
সাংবাদিকের নামে মানহানি মামলার হুমকি চেয়ারম্যানের: সারাবাংলায় সংবাদ প্রকাশের পর সাংবাদিকের নামে ৩০০ কোটি টাকা মানহানির মামলা করার হুমকি দিয়েছেন লাকসুরার চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন। সাংবাদিকদের গালিগালাজ করে ফেসবুক লাইভে জাকির হোসেন বলেন, ‘কালকেই আমি মামলা করব। ৩০০ কোটি টাকা মানহানির মামলা করব। আগে সাংবাদিকের বিচার হবে। তারপর অন্য কথা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ সব নিউজ দিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। এইসব (সাংবাদিক) জানোয়ারের বাচ্চা।’
পরদিন অবশ্য নিজের ফেসবুক লাইভের ভিডিও ডিলেট করে দিয়ে নতুন একটি পোস্ট করেন লাকসুরার চেয়ারম্যান। তিনি ওই পোস্টে বলেন, ‘আমার ব্যবসা নিয়ে রিউমার ছড়ানো হচ্ছে। আমার কোম্পানির টোটাল ট্রানজেকশন ২৫-৩০ কোটি টাকা। যার পুরোটা টাকা প্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। এখন কিছু টাকা ঘাটতি আছে। আশা করি সুযোগ পেলে এই টাকা পরিশোধ করে দেওয়া সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘… বাচ্চা সাংবাদিক এ সব কোথায় পেল। একটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হলে আমিও বসে থাকব না। আমিও আইনি ব্যবস্থা নেব।’ এ সময় তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে আবারও সময় আশা করে বলেন, ‘আপনারা আমাকে সুযোগ দিন, আমাকে ব্যবসা পরিচালনা করতে দিন, আমাকে সময় দিন। আমি সময় পেলে আপনাদের সকলের পাওনাদি পরিশোধ করে দেব।’
প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা: এদিকে, লাকসুরার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাকসুরা মোট তিনটি অফার দিয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম অফারের পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অফারের ৮০ ভাগ পণ্য ডেলিভারি বাকি রয়েছে। আর তৃতীয় অফারের কোনো পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়নি। দুই অফার থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে কোম্পানির কয়েকজন ব্যক্তি। এর মধ্যে চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের নেতৃত্বে তার আত্মীয়-স্বজনরা বিদেশে রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন তারা সময় ক্ষেপণ করছেন। সময়ক্ষেপণের কারণ হচ্ছে— গ্রাহকদের চেকে যে তারিখ দেওয়া হয়েছে তার মেয়াদ শেষ হওয়া। মেয়াদ শেষ হলেই আর কেউ ডিজঅনার করতে পারবেন না। তখন তাদের কাউকে ধরারও বুদ্ধি থাকবে না। এই সুযোগে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরাও সহজে পার পেয়ে গেলেন।’
লাকসুরার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমার রিলেশন বিভাগের কর্মকর্তা নিজেকে আলম নাম দিয়ে বলেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার ২৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে গেছেন। তিনি এই মাসের ২০ তারিখের মধ্যে দেশে ফিরবেন। এর বাইরে আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই।’
চেয়ারম্যান বিদেশে চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
লাকসুরার কাস্টমার রিলেশন বিভাগের ম্যানেজার আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্যার দেশের বাইরে আছেন। তিনি অসুস্থ। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য দেশের বাইরে গেছেন।’
এদিকে লাকসুরার ডেলিভারি ইউনিটের হেড রাহাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘কত গ্রাহকের ডেলিভারি পেন্ডিং রয়েছে, আমরা ওইভাবে হিসাব করিনি। খুব শিগগিরই আমরা অডিট করব, অডিট করার পর বলতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন এখন ই-কমার্সের ক্রান্তিকাল চলছে। এই কারণে আমরা গ্রাহকদের অর্ডারগুলো দিতে পারছি না।’
এদিকে লাকসুরার ম্যানেজার দোহা জেইসাকে একাধিকার কল করা হলেও তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি ও ব্যাংক সংক্রান্ত সমস্যার কারণে আমাদের ডেলিভারি সিডিউলে কিছুটা বিঘ্নতা ঘটছে। এ জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
লাকসুরার নামে কোনো বিভ্রান্তি ছড়ানো হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ওই ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন লাকসুরার ম্যানেজার দোহা জেইসা।
সারাবাংলা/ইউজে/একে