ঠিকাদার প্রমাণ হওয়ায় চাকরি হারালেন ওয়াসার প্রকৌশলী
৩ জানুয়ারি ২০২২ ১৮:০১ | আপডেট: ৩ জানুয়ারি ২০২২ ১৮:৫৫
ঢাকা: কোনো ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে ৪০ লাখ টাকার কাজ করার চেষ্টা করা ও বিবিধ দুর্নীতির দায়ে ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী অসিম কুমার ঘোষকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার এক অফিস আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অফিস আদেশের কপি সারাবাংলার হাতে রয়েছে।
অসিম কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মডস জোন-৮ এর আওতাধীন প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিভিন্ন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ঠিকাদারদের থেকে অর্থ নিয়ে নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ না করেই বিল পরিশোধের চেষ্টা করেছেন এই কর্মকর্তা।
ওয়াসার অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী অসিম কুমার ঘোষ আরও বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। নিজের পদ বলে বিভিন্ন সময় অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিস্তারিত অনুসন্ধান হলে সে সকল বিষয়ও বের হয়ে আসবে।
এদিকে ২০০৮ সাল হতে ব্যবহৃত বিল রেজিস্টারে অসৎ উদ্দেশ্যে কয়েকটি ক্রমিক অর্থাৎ কার্যাদেশ নম্বর বাদ দিয়ে এন্ট্রি করতে সংশ্লিষ্ট ইউডিএকে জোরপূর্বক বাধ্য করেন। বসুন্ধরা পাম্প হাউজ-১ ও ২ এর মেরামত রক্ষণাবেক্ষণের প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার কাজে মাত্র দুই থেকে তিন ট্রাক বালি ফেলে কাজ শেষ দেখান। উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের দিয়ে সম্পূর্ণ বিল মেজারমেন্ট বুকে লিপিবদ্ধ করান। একইভাবে বসুন্ধরা পাম্প হাউজ ৩ ও ৪ এর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সম্পূর্ণ বিল উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে দিয়ে মেজারমেন্ট বুকে লিপিবদ্ধ করান। সরজমিনে দেখা যায় ওই কাজ অসম্পূর্ণ।
অসিম কুমার ঘোষ ২০১৭ সালের ২২ জুন থেকে ওই বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে ওয়াসার থেকে আগে থেকে কোনো অনুমতিই নেননি। এমনকি তিনি এই সময়ে অফিসে উপস্থিত না থেকেও পরে অফিসে এসে পেছনের তারিখ উল্লেখ করে কাগজে স্বাক্ষর করেন ঠিকাদারকে টাকা দেওয়ার জন্য।
অফিস আদেশে ওয়াসা উল্লেখ করেছে, তার আচরণ ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকুরী প্রবিধানমালা, ২০১০ এর ৩৮ (ক), (খ), (চ) ও (ছ) প্রবিধিমতে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ, তহবিল তছরুপ বা প্রতারণা ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কার্যে লিপ্ত বিধায় উক্ত প্রবিধানমালার ৩৯ প্রবিধিমতে আওতাভুক্ত অপরাধ।
এতে আরও বলা হয়, তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২০ জুলাই বিভাগীয় মামলা নং-০৬/২০১৭ রুজু করা হয়। তিনি বিভাগীয় মামলার জবাব দাখিল করেন। দাখিল করা জবাবে ব্যক্তিগত শুনানির ইচ্ছা প্রকাশ করায় তা গ্রহণ করা হয়। তার দাখিলকৃত জবাব ও শুনানিকালে তার দেওয়া বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় বিভাগীয় মামলাটির তদন্তকার্য করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকুরী প্রবিধানমালা, ২০১০ এর ৩৮ (ক), (খ), (চ) ও (ছ) প্রবিধিমতে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ, তহবিল তসরূপ বা প্রতারণা ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাকে তাকে চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান গণমাধ্যমকে জানান, ঢাকা ওয়াসা দুর্নীতি ও অনিয়মের পরিপন্থি একটি সংস্থা। এখানে দুর্নীতিবাজদের কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, ‘নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত রাখতে ওয়াসাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা জরুরি। এ বিষয়ে আমরা বদ্ধপরিকর। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর জায়গা ঢাকা ওয়াসায় নেই। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অপরাধ বিবেচনায় চাকরিচ্যুতও করা হবে।’
সূত্র বলছে, অসিম কুমার ঘোষ সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও আইন অমান্য করে তার মেয়ে প্রমি কুমার ঘোষের নামে মেসার্স প্রমি এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮) ও পিপিএ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এক্ট ২০০৬) অনুযায়ী তিনি তার মেয়ে ও স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানকে তার কাজ দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি কাজ দিয়েছেন। যেটা সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন। সরকারি কর্মচারী হয়েও দাফতরিক কাজ ঠিকমতো না করে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন ঠিকাদারি কাজ নিয়ে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অসিম কুমার ঘোষ ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮ থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪০ লাখ টাকার বিভিন্ন মেরামত ও সংস্কার কাজের ঠিকাদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নিজেই ঠিকাদারের ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ফ্ল্যাট, একই এলাকার কাদেরাবাগ হাউজিংয়ে বাড়ি নং ১, সেকশন-২, ব্লক-ডি‘তে ফ্যাট, তার ও তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় ১৩টি বাড়ি ও প্লট, ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও বসুন্ধরা রিভার ভিউ প্রকল্পে ৮টি প্লট, আমুলিয়া গ্রীন মডেল টাউন ও কেরানীগঞ্জে তিনটি বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বরখাস্ত হওয়া অসিম কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সবই মিথ্যা। আমাকে ঢাকা ওয়াসা নিজের পক্ষে শুনানি করার সুযোগ দিলেও কোনো কথা শোনেনি। সবারই আইনি অধিকার আছে। তাই আমি হাইকোর্টে চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে রিট করব।’
সারাবাংলা/ইউজে/এনএস