এই বিজয় উৎসব আগামী দিনে চলার পথের প্রতিজ্ঞা: প্রধানমন্ত্রী
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:১০ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:১৫
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে বিজয় উৎসব ব্যাপকভাবে উদযাপন করছি। আগের বছর করোনার কারণে আমরা করতে পারিনি। কিন্তু এবার আমরা নতুন উদ্যমে বিজয়ের উৎসব করছি। এই উৎসব শুধুমাত্র উৎসব না। এই উৎসব আমাদের আগামী দিনে চলার পথের প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনা বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব।
বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। তার আগে, সেখান জাতিকে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সমৃদ্ধির শপথ পড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে পরিবেশন করা হয় জাতীয় সংগীত। এরপর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়।
আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং সম্মাননীয় অতিথির হিসেবে বক্তৃতা করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ।
এর আগে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দক্ষিণ প্লাজার অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের আগমনের পর পরিবেশন করা হয় জাতীয় সংগীত। এরপর শপথ করান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে আটটি বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের মানুষ এ শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরের ধারা ও হাল আমলের শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম মুজিবর’ গানের মধ্য দিয়ে শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়, রাত ৮টা পর্যন্ত চলে।
সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতার রাজনীতি হচ্ছে মানুষের অধকার প্রতিষ্ঠা করা, শোষিত নিপীড়িত মানুষের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তিনি তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের জনগণের জন্য। বাংলাদেশের মানুষ যারা একেবারে গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে পড়ে আছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি একটি বিষয়ে সবসময় লক্ষ্য রেখেছেন, এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। আর সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।’
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র হিসাবে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলা ভাষা আন্দেলনের পথ ধরেই তিনি একে একে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে আমাদের একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান। আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র উপহার দেন।’
জাতির পিতার নেতৃত্বে যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ার বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বিজয় পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতার স্বদেশে ফিরে আসার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতীম ভারতের প্রতি কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ওই সময় আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করেন। আর এই চাপের মুখে তারা বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে। এই একবারই না, বারবার তার জীবনে এই ধরনের সমস্যা হয়েছে। ছয় দফা যখন দিয়েছিলেন। সেই ছয় দফা অল্প কিছুদিনের মধ্যে সমগ্র মানুষের যখন তা গ্রহণযোগ্যতা পেল তখনও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। তখন আমার মা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি কখনো সামনে আসেননি। পর্দার আড়ালে থেকেই এই সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন।’
১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকার কথা স্মরণ করেন এবং তিনি জানান, ওই সময় ধানমিন্ডর একটি বাসায় তাদের বন্দি থাকার কথা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরাও কিন্তু সেই বন্দিখানায় ছিলাম। জয়ের জন্মই হয় এই বন্দি দশায়। আমরা কিন্তু মুক্তি পাইনি। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী স্যারেন্ডার করেছিল। কিন্তু আমরা তখনও বন্দিদশায়। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় মেজর অশোক তারা এসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত থেকে আমাদের মুক্ত করে। বাংলাদেশের জনগণের পাশে সবসময় ভারত দাঁড়িয়েছে। আজকে তাদের কথা আমরা সবসময় স্মরণ করি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের জীবনকে উন্নত করার জন্য তিনি যখন পদক্ষেপ নিলেন; অর্থনৈতিক কর্মসূচি এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন; যখন ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে গ্রামের মানুষদের ক্ষমতাসীন করার পদক্ষেপ নিলেন তখনই জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।’
তিনি বলেন, ‘এরপর বাংলাদেশে ১৯টা ক্যূ হয়। বারবার অশান্ত পরিবেশ। কত হাজার হাজার সামরিক বাহিনীর সৈনিক, অফিসার এবং মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ছয় বছর বিদেশে রিফিউজি ছিলাম। ১৯৮১ সালে ফিরে আসি ভারত থেকে। তারপর থেকেই চেষ্টা করেছি। জাতির পিতার আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে। দীর্ঘ সংগ্রামের ২১ বছর পর সরকার গঠন করি। এর পর এক মেয়াদ বাদে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার জয়ী হই এবং তারপর থেকে এই পর্যন্ত সরকারে থেকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করা, এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ৫০বছর আমাদের স্বাধীনতা। আমরা কতটুকু এগুতে পেরেছি! সেটাই বড় কথা। দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। আজ প্রত্যেক ঘরে ঘরে আমরা বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহহারা ও ভূমিহীন মানুষকে বিনা পয়সায় আমরা ঘর দিচ্ছি। এই লক্ষ্য আমরা পূরণ করতে পারব। যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল। জাতির পিতা চেয়েছিলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। আর আমাদের সেটাই লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। যদিও কোভিড আমাদের এগিয়ে যাওয়ায় অনেকটা প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারপরও এই করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছি। আবার আমরা গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করার পদক্ষেপ নিয়েছি। তাছাড়া আমরা সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছি। যেটা জাতির পিতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি দিয়েছিলেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়’। আমরা সেই পররাষ্ট্রনীতি নিয়েই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই আমাদের দেশের উন্নয়নের চাকাকে সচল রেখেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে এবং তারা পালন করছে। সেটা আমরা নিশ্চিত করেছি। বাংলাদেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের লক্ষ্য ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হব। সেটা আমরা অর্জন করেছি। এখন লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, “আমরা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, নারী নির্যাতন ও মাদক নির্মূল করর জন্য ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছি। আমরা দেশের মানুষের শান্তি চাই, নিরাপত্তা চাই।” বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া স্বাগত বক্তব্য দেন- জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা স্মারক তুলে দেন।
এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দুটি স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। স্মারকগ্রন্থগুলো সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম