নিজের প্রচারণায় তোরণে জাতির পিতার সঙ্গে নিজেদের ছবি!
১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৩:২০ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:২৩
ঢাকা: উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা তোরণ। আর সেই তোরণেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সঙ্গে নিজেদের ছবি জুড়ে দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন নেত্রকোনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু ও বারহাট্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মাইনুল হক কাসেম।
তোরণে জাতির পিতার ছবির সঙ্গে দুই নেতার ছবি যুক্ত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হয়েছে— এমন অভিযোগে অনলাইন-অফলাইনে চলছে তীব্র সমালোচনা। একজন প্রতিমন্ত্রী কাজটিতে যুক্ত বলেই অনেকে বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান দাবি করছেন, ব্যতিক্রমধর্মী এই কাজের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজের অবদান স্মরণীয় করে রাখতেই তিনি তোরণটিতে তাদের ছবি ব্যবহার করেছেন।
গত শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু তোরণটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ওই স্থাপনাটির একপাশে জাতির পিতা এবং আরেক পাশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে। উভয়পাশেই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার ছবির নিচে নিজেদের ছবি জুড়ে দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোরণটির ছবি দিয়ে সমালোচনা শুরু হলে মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবির নিচে একটি বর্ডার লাইন দিয়ে নিচে নিজেদের ছবি রাখা হয়েছে। আগের ছবিতে ওই বর্ডার লাইনও ছিল না।
তোরণটি উদ্বোধনের পর বিষয়টি নজরে এলে সাংবাদিক রাজন ভট্টাচার্য তোরণের ছবি শেয়ার করেন ফেসবুকে। তিনি লিখেছেন, ‘মুজিবর্ষ উপলক্ষে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যদি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলায় এই ম্যুরালটি নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাহলে এটি সরাসরি আদালত অবমাননা। কারণ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সঙ্গে অন্য কারও ছবি থাকতে পারে না। দেশের অন্য কোথাও স্থানীয় নেতাদের ছবি যুক্ত করে জাতির পিতার ম্যুরাল নির্মাণ হয়েছে বলে জানা নেই।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এটি অনিচ্ছাকৃত ভুলও হতে পারে। হতে পারে অতি উৎসাহের কারণেও। তবে বিষয়টি এরইমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সর্বোপরি যে উদ্দেশ্যে ম্যুরালটি নির্মাণ করা হয়েছে, তা সফল হয়নি সুচিন্তার অভাবে। রাষ্ট্রের টাকাও অপচয় হলো। স্থাপনাটি স্থায়ীভাবে রাখা হলে বিতর্কের পাশাপাশি দেখতেও দৃষ্টিকটু লাগবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আশা করি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন ও রারহাট্টা উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। সর্বোপরি এ বিষয়ে জেলা-উপজেলা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
ওই পোস্টে বঙ্গন্ধুর ছবির সঙ্গে ওই দুই নেতার ছবি দেওয়ার নিন্দা জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ওই দুই নেতার ছবি প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। ফেসবুকে নেত্রকোনা ও বারহাট্টার স্থানীয়দের আরও অনেকেই এমন পোস্ট দিয়ে সমালোচনা করেছেন। এসব পোস্টের কমেন্টেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
তোরণে জাতির পিতার ছবির সঙ্গে নিজেদের ছবি ব্যবহার নিয়ে জানতে চাইলে বারহাট্টা উপজেলার চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ মাইনুল হক সারাবাংলাকে বলেন, আমরা অবমাননা করিনি। কীভাবে অবমাননা হয়েছে? আমাদের চোখে অবমাননা হয়নি। রিটের ম্যুরাল সংরক্ষণের ব্যাপারে কথা হয়েছে। এটি ম্যুরাল নয়, আমরা সীমানা তোরণ করেছি। বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে আমাদের ছবি দেইনি। আলাদা বর্ডার করে নিচে আমাদের ছবি দিয়েছি। আপনার প্রথমে যে ছবিটি দেখেছেন, সেটি পূর্ণ কাজ নয়। এখন কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে বর্ডার লাইন স্পষ্ট।
জাতির পিতার ছবির সঙ্গে নিজেদের ছবি দিতে হবে কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, কেন আমাদের ছবি মুছে দেবো? প্রত্যেকেই তো নিজের প্রচারণা চায়। আমার জানামতে, দেশের কোথাও সীমানা তোরণে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করা হয়নি। আমি ব্যতিক্রম একটি কাজ করতে চেয়েছি। আমি যে সুন্দর কাজটি করলাম, একসময় তো আমি থাকব না। আগামী প্রজন্ম যেন জানে ব্যতিক্রমী এই কাজটি আমার, সে কারণেই নিচে আমাদের ছবি দিয়েছি। সেটি প্রত্যাহারের প্রশ্নই ওঠে না।
যথেচ্ছভাবে জাতির পিতার ছবি ব্যবহার নিয়ে অবশ্য আপত্তি তুলছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, যেখানে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার আওয়ামী লীগের কালচারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে নিজেদের বিরাট ও বিশালাকার ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সময় বঙ্গবন্ধুর ছবির চেয়ে তাদের ছবিই বড় আকারে দেখা যাচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, অনেক অপরাধী ও সন্ত্রাসী সদ্য নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ছবি ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগকেই দলীয়ভাবে কাঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, কোথায় কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করা যাবে, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে কঠোর হতে হবে। যেখানে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবির ব্যবহার আইন করে বন্ধ করতে হবে। নিজেকে প্রচারের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের অপসংস্কৃতি এখনই বন্ধ করা উচিত।
এদিকে, এই তোরণ নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন, তাদেরই এক হাত নিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সীমানা তোরণে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে আমাদের ছবি দিয়েছে। আমরা তো বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে। বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে বা সঙ্গে তো ছবি দেওয়া হয়নি। যারা সামালোচনা করছে, তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে আমাদের ছবি দিলে আপত্তিকর হতো। যেহেতু সঙ্গে দেওয়া হয়নি, তাই বিষয়টি আমাদের চোখে দৃষ্টিকটু বা আপত্তিকর নয়।’
সমালোচনার মুখে তোরণ থেকে নিজেদের ছবি সরিয়ে নেবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ছবি প্রত্যাহার করা হবে কি না, সেটি পরে দেখা যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আব্দুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সারাবাংলা বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নলেজে নেই। বিষয়টি নিয়ে আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলব।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর