এক কলসি পানির দাম ৩০ টাকা
১১ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:২৭ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:২৮
সুনামগঞ্জ: পানির অপর নাম জীবন। জেলার তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত এলকার মানুষ তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। তাহিরপুরকে বলা হয় হাওরের প্রাণ। কিন্তু উপজেলার সীমান্তবর্তী বড়গোপ টিলায় বছরজুড়ে থাকে পানির তীব্র সংকট। এখানে এক কলস পানি ৩০ টাকা এবং এক ড্রাম (৩৫ লিটার) পানির জন্য ১৫০ টাকা খরচ করতে হয় বাসিন্দাদের। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা নিজেরাই পানি সংগ্রহ করেন।
পানির জন্য সবাইকে ৫০০ ফুট উঁচু টিলায় ছড়িয়ে থাকা পাথরের এবড়ো-থেবড়ো পথে ওঠানামা করতে হয়। এভাবে পাহাড়ি ঝরনা থেকে সংগ্রহ করতে হয় পানি। বাসিন্দারা খাবার ও গৃহস্থালি কাজে এ পানি ব্যবহার করেন। শুষ্ক মৌসুমে ঝরনার পানি সরবহরাহ কমে যায়। আবার বর্ষায় টিলায় ওঠানামা আরও বিপদজনক হয়ে ওঠে। টিলার মাটি শুষ্ক আবার পানির ব্যবস্থাও নেই। তাই টিলায় অধিকাংশ ফসলই জন্মায় না।
এ পরিস্থিতিতে উপজেলার ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন বড়গোপ টিলার ৪৩টি পরিবারের দিন কাটছে অনেক কষ্টে। বড়গোপ টিলার পূর্ব পাশে যাদুকাটা নদী। তবুও পানির জন্য বছরজুড়ে হাহাকার চলে ওই এলাকার দুই শতাধিক বাসিন্দার মাঝে। কয়েক যুগ ধরে এ অবস্থা চললেও টিলাবাসীর পানির সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪২ সালে বড়গোপ টিলায় ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের বাস ছিল। বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৩৩টি ও বাঙালি ১০টি পরিবার সেখানে বাস করেন। ২০০৮ সালে বড়গোপ টিলায় একটি নলকূপ স্থাপন করলেও প্রথম থেকেই এটি অকেজো। বড়গোপ টিলা সংলগ্ন ভারত সীমান্তের মেঘালয় পাহাড়ের বাসিন্দাদের জন্য ওই রাজ্যের সরকার বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে পানির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মেঘালয়ের কাছে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বড়গোপ টিলার বাসিন্দারা আজও পানির সুবিধা পায়নি।
সরজমিনে বড়গোপ টিলায় গিয়ে দেখা যায়, পানির জন্য সেখানে হাহাকার চলছে। পুরুষ থেকে শুরু করে নারীরা ছুটছেন পানির সন্ধানে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা ও উঁচু নিচু পথে পানি নিয়ে উঠতে হচ্ছে অনেক কষ্ট করে। তবে যারা বাড়িতে মটর লাগানো আছে তাদের বাড়ি থেকে এক কলসি পানি তারা ৩০ টাকা করে কিনে আনছেন। এখানেই শেষ নয়, পুরো টিলাই এক টুকরো শাকসবিজর বাগান নেই। গোসল কিংবা কাপড় ধুতে হয় সপ্তাহে একদিন তাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
বড়গোপ টিলার বাসিন্দা লিপি রানি বলেন, ‘স্বামী দিন মজুর। পানি কিনে খাওয়ার মত টাকা আমাদের নেই। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানি ভর্তি দুইটি কলস নিয়ে টিলা বেয়ে ওপরে উঠি।’
বড়গোপ টিলার বাসিন্দা আজিম মিয়া বলেন, ‘১৯৪২ সাল থেকেই এ টিলায় বসবাস শুরু হয়। ২০০৮ সালে রোমান ক্যাথলিক চার্চে একটি নলকূপ স্থাপন করলেও পানি না আসায় প্রথম থেকেই অকেজো হয়ে আছে।’
শিক্ষক মনিরা আজিম বলেন, ‘দিন দিন বড়গোপ টিলায় জনসংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে পানি হাহাকারও বাড়ছে। অনেক সময় এতদূর থেকে পানি আনা সম্ভব হয় না। ফলে সেদিন এক কলস পানি ৩০ টাকা আর ৩৫ লিটারের এক ড্রাম পানি ১৫০ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। পানির সংকটের কারণে টিলায় শাক সবজিসহ কোনো চাষাবাদ কেউ করে না।’
টিলার বাসিন্দা শিফরা দাস বলেন, ‘বর্ষায় পানি নিয়ে টিলায় ওঠানামা আরও কষ্টকর হয়ে পড়ে। আবার হেমন্তে ঝরনার পানি অনেক কমে যায়। তবুও আমরা সেই পানি বাড়িতে নিয়ে এসে ছেঁকে খাবারের জন্য সংগ্রহ করি।’
টিলার বাসিন্দা জুবের মিয়া বলেন, ‘বড়গোপ টিলায় জন্ম নেওয়াটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাপ। জন্মের পর থেকে আমরা পানির জন্য কষ্ট করছি। আমরা কি বাংলাদেশের নাগরিক না। আমরা কি সরকারের সুযোগ সুবিধা পেতে পারি না। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানাই আমাদের পানির কষ্ট থেকে মুক্ত করুন।’
টিলার বাসিন্দা কামরান মিয়া বলেন, ‘৫০০ ফুট উঁচু টিলায় ওঠানামা করে পানি সংগ্রহ আমাদের জন্য অনেক কষ্টকর। পানির যে কত মূল্য সেটা আমরা বুঝতে পারছি। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ আমাদের পানির কষ্ট থেকে মুক্তি দিন।’
সুনামগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কাশেম সারাবাংলাকে বলেন, আসলে পাহাড়ি এলাকায় গভীর নলকূপ করা যায় না। তারপর পাহাড়ি এলাকার পাদদেশে আমরা কিছু নলকূপ স্থাপন করেছি। তবে বড়গোপ টিলায় যে পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে সেই সদস্যা নিরসনে দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সারাবাংলা/এনএস
এক কলসি পানির দাম ৩০ টাকা টপ নিউজ তাহিরপুর বড়গোপ টিলা সুনামগঞ্জ