১৪ বছরেও ক্ষত শুকায়নি সিডরে স্বজনহারাদের
১৫ নভেম্বর ২০২১ ১২:৫৮ | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৩:১১
আজ ভয়াল ১৫ নভেম্বর। আগে ২০০৭ সালের এইদিনে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর। এতে প্রাণ হারান বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসে লাখো পরিবার। সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন ওইসব অঞ্চলের মানুষেরা। চোখের সামনে দেখেছেন, স্বজনদের লাশ ভেসে গেছে গভীর সমুদ্রে। সম্পদহারা, গৃহহারাদের মানুষেরা আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি।
২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় দুর্যোগের আভাস পাওয়া যায়। পরেরদিন এটি ঘূর্ণিঝড় সিডরে রূপ নেয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে হয়ে ওঠে ভয়ংকর। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। তবে এ সময় দমকা হাওয়ার বেগ উঠছিল ঘণ্টায় ৩০৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। সিডরের প্রভাবে উপকূলে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়।
ভয়াবহতার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আতঙ্কের দিন শেষ হয়নি উপকূলে। দীর্ঘদিনেও এসব এলাকার মানুষের নিরাপত্তায় নির্মাণ করা যায়নি স্থায়ী বাঁধ। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার আলম বলেন, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তার কাজ এখনও চলছে। এছাড়া আরও আটটি প্রকল্পের মাধ্যমে মেরামতের কাজ চলছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণে অনেক সংস্কার কাজ এখনো করা সম্ভব হচ্ছে না।
সিডর বিধ্বস্ত বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী গ্রামের বাসিন্দা আলেতুন নেছারের (৭৬) স্বামী, দুই নাতি-নাতনি এবং পুত্রবধূকে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। সিডরের ১২ বছরেও প্রিয়জন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই বৃদ্ধা। এখন রোগে-শোকে অনেকটা অচল হয়ে পড়েছেন ওই নারী।
আলেতুন নেছা জানান, সিডরের রাতে নাতনি শারমিন আক্তার, নাতি বাবু পঞ্চায়েত, পুত্রবধূ আসমা বেগম এবং স্বামী সেকেন্দার আলীকে সঙ্গে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের যাওয়ার পথে হঠাৎ করে বুক সমান পানি চলে আসে। পানিতে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তিনি একটি গাছ ধরে বেঁচে থাকেন। তার স্বামী একটি গাছের ডাল ধরে বাঁচার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি।
প্রতিবেশী রুহুল আমিন পঞ্চায়েত (৫৫) তার দুই ছেলে-মেয়ে এবং বাবাকে হারিয়েছেন সিডরে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তার বংশের দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২২ জন নারী-পুরুষ। স্বজন হারানোর কথা মনে উঠলে এখনো থমকে যায় তারা। শুধু আলেতুন নেছা এবং রুহুল আমিন নয় বলেশ্বর নদী পাড়ের অনেকেই তাদের স্বজনকে হারিয়েছে সিডরে। আবার কেউ কেউ তাদের স্বজনকে আজও খুঁজে পায়নি। কোনো কোনো শিশু বাবা-মাকে হারিয়ে এতিমের খাতায় নাম লিখিয়েছে। রাজৈর গ্রামে খানবংশের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২৬ জন নারী-পুরুষ মারা গেছে সিডরের তাণ্ডবে।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এখনও সেখানে কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর রয়েছে। তার একটি ঘরে আলেতুন নেছার বসবাস। সিডরের পর আশে পাশে কাঁচা-পাকা, সেমিপাকাসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন গ্রাম।
গাবতলা গ্রামের বাহাদুর খান জানান, সিডরে তার এক বোন, চাচা এবং চাচীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন পর ধানক্ষেত থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে দাফন করা হয়।
উত্তর তাফাল বাড়ি গ্রামের মো. জিয়ারুল ফকির জানায়, সিডরের সময় তার বয়স ছিলো মাত্র এক বছর। সিডরের কোনো স্মৃতি তার মনে থাকার কথা নয়। তবে সিডর তাকে এতিম করে রেখে গেছে। এখন জীবিকার তাগিদে সে বলেশ্বর নদীতে মাছ ধরে।
একই এলাকার সেতারা বেগম জানান, সিডরের রাতে গলা-সমান পানি সাঁতরিয়ে তিনি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরের দিন সকালে বাড়িতে এসে দেখি জলোচ্ছ্বাসে বাড়িঘর সব কিছুই ভেসে গেছে। শুধুমাত্র ঘরের পোতা অবশিষ্ট আছে। পরে সরকারি-বেসরকারি সাহায্যে সহযোগিতায় ধীরে ধীরে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন গ্রাম। সিডর প্রথমে সুন্দরবনের পূর্বাংশে আঘাত করে পরে উপকূলীয় গ্রামগুলোতে এসে আছড়ে পরে। জলোচ্ছ্বাসে এক গ্রামের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অন্য গ্রামে। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ মারা যায়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, মৎস্যখামার ও গবাদিপশুসহ মানুষের সহায়-সম্পদ ভেসে যায়। দিনের পর দিন নদী-খালে গবাদিপশুর সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে।
সিডরে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা। এখানে সিডরের আঘাতে নিহত অনেকের লাশ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারি হিসাবে সিডরে শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলায় ৬৯৫ জন মারা গেছেন এবং এখন পর্যন্ত ৭৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। কাছাকাছি সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় সিডরে এতোবেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সারাবাংলা/এএম