সেবাবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠুক এটাই সকলের কাম্য: প্রধানমন্ত্রী
৬ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৩৩ | আপডেট: ৬ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৪৬
ঢাকা: সময়োপযোগী উন্নত প্রশাসন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বিসিএস কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আপনারা নিবেদিত থাকবেন। জনগণের পাশে থাকবেন। মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায় সেটা নিশ্চিত করবেন। নিজেদেরকে নিবেদিত করবেন জনসেবায়। আর নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন এবং সেবাবান্ধব প্রশাসন।
বুধবার (৬ অক্টোবর) রাজধানীর শাহবাগে বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ১১৯তম ও ১২০তম আইন ও প্রশাসন প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী ও সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী গণভবন প্রান্ত থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বিসিএস কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে আপনাদের কি করণীয় সেটা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথেষ্টভাবে সচেষ্ট হয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে জনগণের জন্য, জনগণের সেবক হিসাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে এই যে হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’-এই অল্প কথার মধ্য দিয়ে এই কথাটা প্রমাণিত হয় যে তিনি কী কারণে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে বারবার জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। একটা আদর্শ এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে; এই কথাটা সবসময় মনে রাখতে হবে।
জাতির পিতার নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে আজকে আমরা যতকিছু দেখি, প্রতিটি কাজের ভিত্তিটা জাতির পিতা তৈরি করে দিয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। আমি যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যাই আমার নিজেরই ভেবে অবাক লাগে যে, এতো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এতো কাজ কিভাবে করলেন। প্রতিটি ভিত্তি তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন।
১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় আসীন স্বৈরশাসকদের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মিলিটারি শাসকরা হয়ত বিলাসিতা দেখাতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় বা রাষ্ট্রের কি চাহিদা বা মানুষের কি চাহিদা সেই বোধটা তাদের ভিতরে থাকে না।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা এবং তিনি ১৯৭৫ সালে ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। সেই ভাষণের একটি অংশে তিনি সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় এই গরীব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরীব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মালিক জনগণ। আমাদের সংবিধানে ৭ অনুচ্ছেদেও এই কথাটা বলা আছে। কাজেই সেই শিক্ষাটাই জাতির পিতা দিতে চেয়েছিলেন, সেই বার্তাটাই পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা সার্বক্ষণিকভাবে জনগণের সেবা দেওয়ায় বাধ্য এবং আমি আশা করি আপনারা সাংবিধানিক এই দায়বদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে জনগণের সেবায় নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করবেন।
তিনি বলেন, আপনাদের প্রতিটি নাগরিক-দাফতরিক কর্মকাণ্ডে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রযুক্তির যুগ। অনেক জ্ঞান এবং মেধা নিয়েই আপনারা জন্ম নিয়েছেন এবং বড় হয়েছেন। সেই সুযোগ কিন্তু আমাদের ছিল না। কিন্তু আপনাদের আছে। এখন পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর যেকোনো তথ্য আপনারা পেতে পারেন। কাজেই সেখানে আপনাদের আরও বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নিজেদের জ্ঞান-মেধা দিয়ে স্ব স্ব কর্মস্থলে সেখানকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কি কি করণীয় সেটা আপনাদেরকেই ঠিক করতে হবে। আপনাদের সেই উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনাটা যেন থাকে।
শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক কাজ করার জন্য না, বাংলাদেশের ভবিষ্যতে কি হবে তার পরিপ্রেক্ষিতেও পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে যখন আমরা নির্বাচনি ইশতেহারটা তৈরি করি সেই নির্বাচনি ইশতেহার তৈরি করার সময়ই আমাদের চিন্তা ছিল ভবিষ্যতে আমরা কি করব। বর্তমানে আমরা ২০২১ সালে এসে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমাদের এটাকে ধরে রাখতে হবে। এখান থেকে আমরা যেন কোনোভাবে পিছিয়ে না যাই। কারণ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যে কয়েকটি উপাত্ত প্রয়োজন, আমরা তা অর্জন করেছি এবং বেশ অগ্রগামী আছি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কেমন বাংলাদেশ হবে সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিয়েছি। এটার ভিত্তিতেই আমরা কিন্তু পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। এরপর নবম-দশম আমাদের করতে হবে।
২০৪১ সালের বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আজকের নবীন অফিসারদেরই কাজ করতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা থাকবেন সেই ২০৪১ সালের সৈনিক। এই চিন্তা করে আপনাদের তৈরি হতে হবে, কাজ করতে হবে। তার পরবর্তীতে আসছে ২০৭১। ২০৭১ সালে আমরা স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করব। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসাবে গড়ে উঠবে। পাশাপাশি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত এসডিজি সেটাও আমরা পালনে যথেষ্ট অগ্রগামী।
বিসিএস কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ২০৪১ সালের যে পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের উপর বর্তায়। আপনারা সেই সৈনিক হিসাবে যখন কাজ করবেন। সামনে ২০৭১ সালে আমাদের শতবর্ষের বাংলাদেশকে কিভাবে উন্নত করব সেটাকে মাথায় রেখেই ২১০০ সাল পর্যন্ত আমরা ডেল্টা প্ল্যান পরিকল্পনা করে দিয়েছি। কারণ বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। এই বদ্বীপ ভূখণ্ডের মানুষগুলি ভবিষ্যতে কিভাবে থাকবে এবং নতুন প্রজন্মের যারা জন্মগ্রহণ করবে এবং এখানে বসবাস করবে, তাদের যেন আমাদের মতো কষ্ট ভোগ করতে না হয়, বঞ্চনার স্বীকার হতে না হয়, তারা যেন একটা সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়। এই লক্ষ্য রেখেই আমরা এই পরিকল্পনাগুলি করে দিয়ে গেলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা আইন প্রশাসনের কোর্স থেকে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সময়োপযোগী উন্নয়ন প্রশাসন গড়ে তুলুন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আপনারা নিবেদিত থাকবেন। জনগণের পাশে থাকবেন। মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায় সেটা নিশ্চিত করবেন।
করোনাকালীন সময়ে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করার উদ্যোগ গ্রহণের কথা তুলে শেখ হাসিনা বলেন, এটার কারণ হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে আইনের সেবা দেওয়া, বিচার ব্যবস্থাটাকে অব্যাহত রাখা। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে, কারণ আমি তার ভুক্তভোগী। ৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর খুনিদের বিচার যেন না হয় সেজন্য ইমডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। অর্থ্যাৎ বিচারের হাত থেকে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ১৫ আগস্ট আমরা যারা বাবা-মা-ভাই হারিয়েছি আমাদের কোনো অধিকার ছিল না, একটা মামলা করার বা বিচার চাওয়ার উপায় ছিল না। যদিও ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর আমরা সেই আইনটি বাতিল করে দিয়ে খুনিদের বিচার করেছি এবং বিচারের রায়ও কার্যকর করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। আমি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী না, জনগণের সেবক হিসেবে দেখি। আমি মনে করি আমার দায়িত্ব জনগণের সেবা করা। আপনাদের কাছ থেকেও আমি এটা চাই। আপনারা জনগণের সেবক হিসেবেই কাজ করবেন।
তিনি বলেন, নবীন কর্মকর্তাদের বলব যে আপনারা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান-মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সম্মিলিতভাবে দেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবেন এবং মাঠ প্রশাসনে জনগণের সেবা করার যে অবারিত সুযোগ রয়েছে, সেটা কাজে লাগাবেন। সরকারি কর্মকারীদের অন্যতম বড় প্রণোদনা হল পদোন্নতি। ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে সকল ব্যাচকে তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এসময় সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, আবাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, গৃহঋণ, গাড়ি ক্রয় ঋণসহ তার সরকারের মেয়াদে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। সরকারি কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য কিছুটা সময় বাড়িয়েছি এবং আশা করি ভবিষ্যতে বোধহয় আরেকটু সময় বাড়িয়ে দেওয়া হবে। যেন একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে যেন মাঠ পর্যায়ে সবাই যেতে পারে, তার কাজটা বুঝে নিতে পারে, সেই ব্যবস্থাটাই আমরা করতে চাই। একটা দেশকে যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কিন্তু আসলে কাজ করে একটা দক্ষ ও দূরদর্শী সিভিল সার্ভিস। যেটার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচিত হয়ে আসি স্বল্প সময়ের জন্য, পাঁচ বছরের জন্য। যারা আপনারা থাকেন, আপনারা দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকেন। কিন্তু একটা আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। লক্ষ্য স্থির রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির পিতা বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম বক্তব্য রাখেন। সূচনা বক্তব্য দেন বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর মোমিনুর রশিদ আমিন। দুই ব্যাচের দুইজন প্রশিক্ষণার্থী তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয় এবং প্রশিক্ষণে প্রথম স্থান অর্জনকারীদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী রেক্টরস অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন।
এসময় করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেও কষ্ট করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, আয়োজন করাসহ যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
সারাবাংলা/এনআর/এসএসএ