দারিদ্র্য বেড়ে ৫ বছর আগের অবস্থানে, সবচেয়ে নাজুক কুড়িগ্রাম
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৫৯ | আপডেট: ১ অক্টোবর ২০২১ ০০:০৮
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দেশে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। আগের পাঁচ বছরে এই হার কমে এলেও করোনা মহামারি দেশের দারিদ্র্যের হারকে সেই পাঁচ বছর আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশে অতি দরিদ্রের হারে শীর্ষে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা, দ্বিতীয় অবস্থানে পার্বত্য বান্দরবান। দুই জেলাতেই বর্তমানে অতি দরিদ্রের সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি।
বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ‘এক্সট্রিম পোভার্টি: দ্য চ্যালেঞ্জেস অব ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। সরকারের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) যৌথভাবে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এ বছরের জানুয়ারি মাসের হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ। এর আগে ২০১৬ সালেও দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল একই। এরপর থেকে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত কমতে থাকলেও করোনাভাইরাসের অভিঘাতে ফের বেড়েছে এই হার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি দরিদ্র মানুষের হার সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রাম জেলায়। এই জেলার ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র অবস্থানে রয়েছেন। অতি দরিদ্রের হারে এর পরেই রয়েছে বান্দরবান, যেখানে ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র। আর তৃতীয় স্থানে থাকা দিনাজপুর জেলায় অতি দরিদ্রের হার ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে এই তালিকায় সবচেয়ে নিচে রয়েছে নরায়াণগঞ্জ জেলা। এর পরের অবস্থানে থাকা দুই জেলা হলো মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জ।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি স্থায়ী কারণ নদী ভাঙন। প্রতিবছর ৫৫ হাজার পরিবার কেবল নদী ভাঙনের শিকার হয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েন। এজন্য দরিদ্রবান্ধব সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া আয়ের বাইরে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বিষয়টিও হিসাবে আনতে বলা হয়েছে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। জিইডির ভারপ্রাপ্ত সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। আলোচক ছিলেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন ও জুডিথ হার্বাসটন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষক জুলফিকার আলী ও বদরুন্নেছা আহমেদ।
প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে মূল প্রবন্ধে বলা হয়— কুড়িগ্রাম জেলায় গুরুতর অসুস্থায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ। এছাড়া এই জেলায় ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৬০ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে মাত্র ৮ শতাংশ। দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক সংখ্যা এই জেলায় ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যুক্ত রয়েছেন এ জেলার ১৩ শতাংশ মানুষ, যা জাতীয় পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ। এছাড়া নারীপ্রধান পরিবারে অতি দরিদ্রের হার এই জেলায় ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে— মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার ১১ দশমিক ১০ শতাংশ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ১৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, বৌদ্ধদের মধ্যে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ, খ্রিষ্টানদের মধ্যে ২১ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এ হার ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দরিদ্র কি কেবলই অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে নাকি এর পেছনে গভীর কোনো বিষয় আছে, সেটি ভেবে দেখতে হবে। একজন মানুষও না খেয়ে থাকলে সেটি স্বস্তির কথা নয়। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বিচারে দেখা যাচ্ছে সুনামগঞ্জ শীর্ষে, সংখ্যা বিচারে কুড়িগ্রাম। আগামীতে এ অবস্থা আর থাকবে না।
মন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের দারিদ্র্য দৃশ্যমান বেশি হয়ে থাকে। এটা কী কারণে হয়, জানি না। এমন হতে পারে যে আবহাওয়াগত কারণে মানুষ খোলা গায়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে, কিংবা গামছা পরে থাকতে চায়। এ নিয়েও গবেষণা দরকার।
প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনে কাজ চলছে। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা দারিদ্র্য ৩ শতাংশের মধ্যে অর্থাৎ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাই। নদী ভাঙন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে নগর দারিদ্র্য আছে। কিন্তু সেটি ওইভাবে আলোচায় আসে না। দারিদ্র্যবান্ধব সরকারি বিনিয়োগ আরও বেশি প্রয়োজন। যেমন— সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পাশাপাশি প্যাকেজ কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। এই প্যাকেজে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা যুক্ত করতে হবে।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সঙ্গে দারিদ্র্য হারও কমছে। কিন্তু সেটি কমে গিয়েও ২০১৬ সালের অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র্য। দেশে বৈষম্য যে প্রকট, সেটি দেখা যাচ্ছে কুড়িগ্রাম আর নারায়ণগঞ্জের অতি দারিদ্র্যের হারের মধ্যে পার্থক্য দেখে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর