সাড়ে ৪ বছরে দায়িত্ববণ্টন, ব্যর্থতা চাপানোর কৌশল বলছে একাংশ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২১ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৪৪
ঢাকা: প্রায় সাড়ে চার বছর পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্ববণ্টন করা হয়েছে। সংগঠনের নেতাদের একাংশের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখতেই বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব এত দিনেও বণ্টন করা হয়নি। সামনে সম্মেলনের আভাস পেয়েই হয়তো সাড়ে বছর পর নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের ওপর চাপানোর অপকৌশল হিসাবে এই দায়িত্ববণ্টন করা হয়ছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের অস্থায়ী অফিসে এক বৈঠকে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্ববণ্টন করা হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই করা এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, মহিলা আওয়ামী লীগের নেতারা সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তারই আলোকে ২০২৪ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল মহিলা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনমুখী ও শক্তিশালী করতে মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের নেতৃত্বে সম্পাদকমণ্ডলী ও সদস্যদের সমন্বয়ে সাংগঠনিক বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়েছে।
চিঠিতে সাংগঠনিক টিমের সবাইকে তাদের কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালনার আহ্বান জানানো হয়েছে। কোনো টিমের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ও ব্যর্থতা দেখা গেলে সংগঠনের সাংগঠনিক টিমে পরিবর্তন আনা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহিলা আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রীরা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদা বেগম লিপি, সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেলা পারভীন রানু, সহ-প্রচার সম্পাদক মেহের নিগার হোসেন তন্ময়, সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার সৈয়দা সীমা করিম এবং সদস্য শাহানাজ হাবিব, ফেরদৌসি খানম ইলি ও মিনু রহমান।
রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা পান্না, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া প্রাচী, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক নাজমা আফরিন সুমনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মরিয়ম বিনতে হোসাইন খেয়া এবং সদস্য শাহিদা চৌধুরী তন্বী ও আয়েশা মোকাররম।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল হাসান বিথী, সাংগঠনিক সম্পাদক দিলরুবা জামান শেলী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সৈয়দা রাজিয়া মোস্তফ, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক তাহমিনা খানম, সমবায় সম্পাদক দিলারা মোস্তফা এবং সদস্য বেবী বড়ুয়া, মরিয়ম বেগম তামান্না, হাবিবা নজরুল, সুরাইয়া চৌধুরী ও লিপি জামান।
খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীনা মালেক, সাংগঠনিক সম্পাদক ঝর্ণা বাড়ৈ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আফরোজা হাসমত, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সাবিহা সেতু এবং সদস্য অজিফা খানম, কণা জব্বার ও গোলেনতাজ রুবী।
ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমা হোসেন বেবী, সাংগঠনিক সম্পাদক সুরাইয়া বেগম ইভা, শ্রম সম্পাদক নাজমা সালাম এবং সদস্য শামসুন্নাহার পারভীন, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহিনা বেগম ও নাজমা বেগম।
বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিখা চক্রবর্তী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমত আরা হ্যাপী, আইন সম্পাদক রোকেয়া বেগম, দফতর সম্পাদক রোজিনা নাসরিন রোজী, ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক হোসেন আরা বেগম রানি এবং সদস্য লিপি জামান, দিপীকা সমাদ্দার ও রেবেকা সুলতানা।
ঢাকা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমের নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুন্নেসা মান্নান, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আনার কলি পুতুল, সমাজকল্যাণ সম্পাদক সেলিনা আক্তার, কোষাধ্যক্ষ তাহেরা পারভীন এবং সদস্য আয়েশা আক্তার, রাজিয়া আমিন, অধ্যাপিকা শিরিন বেগম, ইসরাত জাহান স্মৃতি ও মেহজাবিন আরা।
রাজশাহী বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন— যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিরিন রুখসানা, সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরন সুলতানা, প্রচার সম্পাদক নীলিমা আক্তার লিলি, সহ দফতর সম্পাদক সোহাইলা আফসানা ইকো, মানবসম্পদ সম্পাদক আঞ্জুমান আরা আয়না এবং সদস্য নুসরাত ফারহানা ইলোরা ও মোহসেনা খানম।
দায়িত্ববণ্টনের এই চিঠি ইস্যু হওয়ার পর সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেত্রী বলছেন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের এত দিনের সাংগঠনিক ব্যর্থতার দায়ভার পরোক্ষভাবে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ওপর চাপানোর কৌশল হিসেবেই এই দায়িত্ববণ্টন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল থেকে দলকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছেন সাংগঠনিক অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ধারাবাহিকতায় দলের মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোরও সম্মেলনেরও হয়তো চলতি বছরেই করার ব্যাপারে নির্দেশনা আসতে পারে। এমন আভাস পেয়েই ‘লোক দেখানো’র খাতিরে বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্ববণ্টন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহিলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ছিল। কিন্তু তার আগে কেন আমাদের বিভাগীয় দায়িত্ববণ্টন করা হয়নি? এখন আবার দায়িত্ব দিয়েই সাংগঠনিক ব্যর্থতার দায়ভার কৌশলে বিভাগীয় টিমের ওপর চাপাতে চাচ্ছেন। উনারা (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) বুঝতে পারছেন, সংগঠনের ভেতরে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই সাংগঠনিক দায়িত্ববণ্টন করতে পারেননি। এছাড়া সংগঠনের আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
এর বিপরীত মতও রয়েছে। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেরিতে হলেও দায়িত্ববণ্টনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী বলেন, আমি বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। দায়িত্ব পেলেও আমরাই যে কাজ করব, তা তো নয়। আমাদের সভাপতি-সেক্রেটারির সঙ্গে টিমওয়ার্ক করেই কাজ করতে হবে।
সংগঠনে আধিপত্য ধরে রাখা কিংবা ব্যর্থতার দায়ভার চাপানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম। তিনি বলেন, কে কীভাবে কাজ করছে— এসব বিবেচনায় না নিয়ে হঠাৎ করে দায়িত্ববণ্টন করলে তো হবে না। ছাত্রলীগের অনেকে এবার আমাদের সঙ্গে জয়েন করেছে। মহিলা আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে তাদের ভালো পরিচয়ও ছিল না। আমরা তাদের নিয়ে বিভিন্ন জেলায় গিয়েছি। সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তারা একটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এখন আমরা তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছি যেন তারা কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে। হঠাৎ করেই কাউকে দায়িত্ব দিলে তো হবে না।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে মহিলা আওয়ামী লীগ গত বছর দেড়েক সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কার্যক্রম পালন করতে পারেনি— এ বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন মাহমুদা বেগম।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সবশেষ ২০১৭ সালের ৪ মার্চ সংগঠনের সম্মেলনে নতুন সভাপতি হন সাফিয়া খাতুন এবং সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদা বেগম। এর সাড়ে চার বছর পর এসে সংগঠনের বিভাগীয় দায়িত্বগুলো বণ্টন করা হলো।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর