সোলায়মান থেকে ডা. মোস্তফা সরোয়ার, নাম বদলেই চক্ষু চিকিৎসক!
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৪৮ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৫৯
রাজবাড়ী: নিজের নাম পাল্টে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থেকে সরাসরি হয়ে গেছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন চিকিৎসক। শুধু তাই নয় শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অনুমোদনহীন চক্ষু হাসপাতাল খুলে রীতিমত রোগী দেখছেন তিনি। এমনই এক ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ নামক প্রতারকের খোঁজ মিলেছে রাজবাড়ীতে। ২০২০ সাল থেকে প্রতারণার মাধ্যমে এমন কার্যক্রম চালালেও ওই প্রতারক ও চক্ষু ক্লিনিকটির কথা জানতেন না সিভিল সার্জন থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকও। চিকিৎসক নামধারী ওই প্রতারকের নাম মো. সোলায়মান হোসেন ও আর তাকে সহায়তাকারী হলো তারই দ্বিতীয় স্ত্রী শিমুল মুন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোলায়মান হোসেন পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদে চাকরি করতেন। ২০২০ সালে রাজবাড়ী শহরের বড়পুলে রাবেয়া টাওয়ারের তৃতীয় তলায় সরকারি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে তোলেন ‘আইভি আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টার’ নামে চক্ষু হাসপাতাল। সেখানে নিজের নাম পাল্টে সোলায়মান হোসেন থেকে সেজে যান বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার। এই নামেই তৈরি করেন ভিজিটিং কার্ড ও সাইনবোর্ড।
ভিজিটিং কার্ডে তার উপাধি দেওয়া হয় সিয়াম সামী আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টারের কনসালটেন্ট হিসেবে। ভিজিটিং কার্ডে দেওয়া ‘সিয়াম সামী আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টার’টি কোথায় সেই ঠিকানা না দেওয়া থাকলেও সেখানে এমবিবিএস, ডি.ও (ডি.ইউ) এ.পি.ডি/স্পেশাল ট্রেনিং মাইক্রো সার্জারি, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, ঢাকা/ট্রেইন্ড ইন অরবিস (আমেরিকা) নামে নানা ডিগ্রির কথা উল্লেখ করা হয়। একইভাবে ক্লিনিকটির চেম্বারেও তার পরিচয় লিখে রাখা হয়। চেম্বারের অপরপ্রান্তে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ৮-১০টি বেড। একই ভবনের পঞ্চম তলায় দ্বিতীয় স্ত্রী শিমুল মুনকে নিয়ে বসবাসও করেন তিনি।
২০২০ সাল থেকে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার সোলায়মান হোসেন বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার সেজে ৫০০ টাকা ভিজিট নিয়ে চক্ষু রোগীদের চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারণা করে আসছেন। এই প্রতারণার কাজে তাকে সহযোগিতা করছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী শিমুল মুন। শিমুল মুনও নিজেকে অপথালমোলজিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন।
পাবনার বেড়া থেকে সপ্তাহে ৩ দিন (বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার) রাজবাড়ী এসে মিথ্যা চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে চক্ষু রোগী দেখেন সোলায়মান হোসেন।
যেভাবে মিললো প্রতারকের খোঁজ
ভুক্তভোগী রোগীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পর গত বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে এই প্রতিবেদক ছদ্মনাম (রাশিদুল ইসলাম) ব্যবহার করে আইভি আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টারের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে সিরিয়ালের জন্য দেওয়া নম্বরে ফোন করে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ারের সিরিয়াল চান। এসময় অপরপ্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠে এক ব্যক্তি জানান, আইভি আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টারে বিকেল ৩টা থেকে ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার রোগী দেখবেন। বিকেল গেলেই চিকিৎসক দেখানো যাবে। রাশিদুল ইসলামের সিরিয়াল নম্বর-১২ বলেও জানান তিনি।
এরপর বিকেলে আইভি আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টারে গেলে রিসিপশনে বসা মো. সোলায়মান হোসেনের স্ত্রী শিমুল মুন নিজেকে অপথালমোলজিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন এবং ভিতরে ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার রোগী দেখছেন বলে জানান। এসময় ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ড চাইলে ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ারের নামে বানানো ভিজিটিং কার্ড বের করে দেন সোলায়ামান হোসেনের স্ত্রী শিমুল মুন।
এরপর তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ভিজিট নিয়ে একটি সাদা প্রেসক্রিপশন ও একটি মানি রিসিট দিয়ে ভিতরে পাঠান। ভিতরে প্রবেশের পর সেখানে চিকিৎসকের চেয়ারে বসা সোলায়মান হোসেন নিজেকে ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার হিসেবে পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকের চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেন।
এসময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা ক্যামেরাপারসন কথাগুলো ভিডিও করার জন্য ক্যামেরা বের করলে ভোল পাল্টে ফেলেন সোলায়মান। ক্যামেরার সামনে তিনি নিজেকে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। এরপর রোগীদের সঙ্গে নিজের প্রতারণার কথা ও দোষ স্বীকার করে নিউজ না করার জন্য এই প্রতিবেদকের কাছে মিনতি শুরু করেন সোলায়মান। এমন প্রতারণা পরবর্তীতে আর কখনও করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোলায়মান হোসেন নিজেকে যে নামে পরিচয় দিতেন সেই চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও ফ্যাকো সার্জন ডা. মো. মোস্তফা সরোয়ার টাঙ্গাইলের রোকেয়া আই কেয়ার এন্ড ফ্যাকো সেন্টারের পরিচালক ও চিফ কনসালটেন্ট। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রাজবাড়ীর আইভি আই কেয়ার অ্যান্ড ফ্যাকো সেন্টারের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। এখানে তিনি কোনদিন রোগীও দেখেননি। তার নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ প্রতারণা করে তাহলে সেই প্রতারকের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফাতেমা তুজ জান্নাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সোলায়মান হোসেন বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত। এখানে তার ডিউটি তিনি ঠিকমতই পালন করেন। এখানে তার স্ত্রী ও দুই ছেলেও রয়েছে। রাজবাড়ীতে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও প্রতারণার বিষয় আমার জানা ছিলো না। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. ইব্রাহীম মো. টিটোন বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, ‘বিষয়টি আমার আগে জানা ছিল না। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এমও
কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার চক্ষু চিকিৎসক টপ নিউজ ডা. মোস্তফা সরোয়ার প্রতারণা ফ্যাকো সার্জন মো. সোলায়ামন হোসেন