১০ লাখ মানুষের ৭ লাখ গাড়ি, দূষণ ঠেকাতে মরিয়া মেয়র
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:০৩ | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:৫৯
সপ্তম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা পোল্যান্ডের ঐতিহাসিক শহর ক্র্যাকাও। শহরটিতে রয়েছে হাজার বছরের পুরনো অসংখ্য স্থাপনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করলেও শহরের কাঠামোতে লাগেনি একবিন্দু পরিবর্তনের ছোঁয়া। কিন্তু ঐতিহাসিক নিদর্শনে ঠাঁসা এই শহরও আধুনিকতার আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি। ঐতিহাসিক শহরটিতে গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশ দূষণের মাত্রা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। হুমকির মুখে পড়েছে নাগরিক স্বাস্থ্য।
শহর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, প্রায় দশ লাখ মানুষের এই শহরে প্রতি একশ জনের বিপরীতে গাড়ি রয়েছে ৭০টি। অর্থাৎ এই শহরে গাড়ি আছে প্রায় সাত লাখ। বিপুল সংখ্যক এই গাড়ির কারণে ক্র্যাকাওয়ে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। পরিবেশগত এই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত কর্তৃপক্ষ। তবে হাত গুটিয়ে বসে নেই শহরের মেয়র। সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে মেয়র অফিস।
ক্র্যাকাওয়ের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বোর্ডের পরিচালক লুকাস ফ্রানেক বলেন, ‘শহরটি যখন গড়ে উঠেছিল তখন এখানে এত বিশাল সংখ্যক গাড়ি চলবে তা কেউ ভাবেনি। ফলে এখন শহরের রাস্তায় এত গাড়ির জায়গা হচ্ছে না। বিশেষ করে শহরের ঐতিহাসিক অংশের রাস্তাগুলো পোল্যান্ডের অন্যান্য শহর যেমন ওয়ারস, ব্রোকল বা পোজন্যানের মতো গাড়ি চলাচলের উপযোগী নয়। তাছাড়া গাড়িগুলো ক্র্যাকাওয়ের ভয়াবহ বায়ুদূষণের জন্য প্রধান দায়ী। ফলে নগর কর্তৃপক্ষ বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।’
শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্যক্তিগত গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। কিছু রাস্তা শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য উন্মুক্ত। পায়ে হাঁটা ছাড়াও কিছু রাস্তায় শুধুমাত্র সাইকেল ও স্কুটার চালানোর অনুমতি রয়েছে। পথচারী ও সাইকেল চালানোর জন্য ফুটব্রিজ তৈরি করা হয়েছে—যেগুলো পোল্যান্ডের অন্যান্য শহরের ফুটব্রিজগুলোর চেয়ে অনেক বড়।
এছাড়াও ক্র্যাকাওয়ের যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানে ‘পনের মিনিটের শহর’ নামক একটি উদ্যোগ চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো, শহরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু যেন পনের মিনিটের হাঁটা বা বাইসাইকেল চালানোর দূরত্বেই পাওয়া যায়। শহরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সম্মতি পেলে কর্তৃপক্ষ এই নীতি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের লো-কার্ব প্রোজেক্টের আওতায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ক্র্যাকাওয়ে পাবলিক বৈদ্যুতিক বাইসাইকেল সিস্টেম চালু করা হয়েছে। ক্র্যাকাওয়ের বাসিন্দারা এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন। মারেক রাইবারজিক নামে এক ব্যক্তি নিয়মিত বিদ্যুৎচালিত এসব সাইকেল ব্যবহার করেন। তিনি ইউরো নিউজকে বলেন, এসব সাইকেল শুধু বিনামূল্যেই ব্যবহার করতে পারছেন তা নয়, এসব সাইকেল শহরের সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায়গুলোতে সহজেই পাওয়া যায়। তাছাড়া বিদ্যুৎচালিত হওয়ায় এগুলো চালানোও সহজ।
তবে ক্র্যাকাওয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থায় আনা এসব পরিবর্তন যে সবাই আন্তরিকভাবে স্বগত জানিয়েছে তা নয়। ক্লিন ট্রান্সপোর্ট অঞ্চলের উদ্যোক্তারা এসব উদ্যোগে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। এসব এলাকায় অবস্থিত রেস্তোরাঁ এবং দোকানগুলোতে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়েই পণ্য বেচাকেনার অনুমতি রয়েছে এবং ক্রেতাদের সেখানে গাড়ি চালানোর অনুমতি নেই। উদ্যোক্তারা বলছেন, এই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তাদের ব্যবসায় সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ক্র্যাকাওয়ের কাজিমিয়ার্জ এলাকার একজন উদ্যোক্তা ইজাবেলা ববুলা জানান, তাদের এলাকা এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর আওতায় রয়েছে। তার মতে, মানুষ সাধারণত একসঙ্গে এক জায়গা থেকে অনেক জিনিস কিনে থাকেন এবং পণ্য সাধারণত গাড়িতে বহন করতেই স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা বোধ করে । নতুন ব্যবস্থাপনায় কেনাকাটায় সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও শহরের বায়ু দূষণ কমাতে বদ্ধপরিকর। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের সুবিধা-অসুবিধা আমলে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নাগরিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের এই আলোচনা বছরের শেষ বা আগামী বছরের শুরুর দিকে হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ক্র্যাকাওয়ের ডেপুটি মেয়র আন্দ্রেজ কুলিগের মতে, শহরের নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিষয়টি মেয়রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বাসিন্দাদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চান তিনি।
এদিকে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বায়ুদূষণ নিয়ে আলোচনার দ্বার অনেকটাই উন্মুক্ত। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণের সমস্যা, প্রতিকার, প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। মহামারির কারণে অনেক বাসিন্দাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম ব্যবস্থায় অফিসের কাজ করেছেন। ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। এতে বিশ্বের অন্যান্য শহরের মতো ক্র্যাকাওয়ের বায়ুমানেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে। শহরবাসীও এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। তবে মহামারির প্রাদুর্ভাব শিথিল হওয়ায় আবার সবকিছু আগের পরিস্থিতিতে ফিরে আসতে শুরু করেছে— পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণও। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে সব পক্ষকেই।
সারাবাংলা/আরএফ/আইই