আফগানিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার পথে বাধা আমেরিকা
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৪২ | আপডেট: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:৪৮
বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের মৌলিক সাদৃশ্যের জায়গা তুলে ধরে, দুই দেশের আলাদা গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়া এবং স্বার্থকেন্দ্রিক নানান পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে দ্য ফেডারেলের জন্য মতামত লিখেছেন বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সাংবাদিক ও লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য ওই নিবন্ধটি অনূদিত করে প্রকাশ করা হলো।
সত্তরের দশকে সমাজতন্ত্রের উত্থান ঠেকাতে আমেরিকা তার মিত্রদের পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই বিপ্লববিরোধী দমন অভিযান পরিচালনা করেছিল। সেই অভিযানে একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংস হলেও, অন্যটি এগিয়ে যাওয়ার অপ্রতিরোধ্য গতি পেয়েছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক জন পিলগার তার দ্য গ্রেট গেম অব স্ম্যাশিং ন্যাশনস বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) আফগানিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থীদের সহায়তায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ দাউদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অপারেশন সাইক্লোন নামে পরিচিত ওই রক্তক্ষয়ী অভিযানের মাধ্যমে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে।
দাউদ খান ছিলেন আফগান রাজা জহির শাহের চাচাতো ভাই। যিনি ১৯৭৩ সাল এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরবর্তীতে পিডিপিএর সমর্থনে সেনা সদস্যের আক্রমণে তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্য রাজপ্রাসাদের মধ্যেই মারা পড়েন।
সে সময় কাবুলে থাকা বিদেশি সাংবাদিকদের বরাতে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, তারা সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করছেন ওই সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সাধারণ আফগানরা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নতুন পতাকা নিয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সরকারের প্রতি আফগানদের আনুগত্য ভয়াবহ প্রশ্নের মুখে’।
আধুনিকতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক এবং কিছুটা সমাজতন্ত্র ঘেঁষা সরকার আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে দূরদর্শী সংস্কার বাস্তবায়ন, সংখ্যালঘু এবং নারীদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ, রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া এবং পুলিশি নথি জনসম্মুখে পুড়িয়ে ফেলার মতো কর্মসূচি হাতে নেয়।
বিশেষ করে রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা অবস্থায় যেখানে আফগানিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৫, প্রতি তিন জনে এক জন সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মৃত্যু হচ্ছিল, মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের ছিল না কোনো অক্ষরজ্ঞান। পিডিপিএ সরকার ক্ষমতায় এসেই নতুন চিকিৎসাসেবা নীতি হাতে নেয়। পাশাপাশি, নাগরিকদের সাক্ষরতার হার বাড়াতে গণশিক্ষার ওপরও জোর দেয়।
নারীদের জন্য সেখানে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছিল না। ১৯৮০ সালের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই ছিলেন নারী। চিকিৎসকদের মধ্যে নারী ছিলেন ৪০ শতাংশ। নারী শিক্ষক ছিলেন ৭০ শতাংশ। সিভিল সার্ভিসেও ছিলেন ৩০ শতাংশ নারী।
যদিও পিডিপিএ সরকার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত, তারপরও তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের দাসত্ব করেনি তারা।
এ ব্যাপারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সেক্রেটারি সিরাস ভ্যান্স তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আফগানিস্তানের ওই অভ্যুত্থানে রাশিয়ার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জিমি কার্টার ছিলেন অপারেশন সাইক্লোনের অন্যতম অনুমোদনকারী।
এরপর ওই অভ্যুত্থানকে উজ্জীবিত রাখতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনা পাঠানো শুরু করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান-সৌদি আরব মিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তাদের ‘নিজস্ব ভিয়েতনাম’ ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসলে দেখা যায়; ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশটির স্বাধীনতা আসে। বাংলাদেশের জন্মকে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হিসবে দেখা হয়। কারণ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঘনিষ্ঠ সহচর জেনারেল ইয়াহিয়াকে তিনি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন।
মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুজ বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভুলিউশন বইয়ে লিখছেন—১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরিকল্পনার সঙ্গে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার কথা। শেখ মুজিবকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করত ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। তাকে হত্যার পর বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের জন্য দুই সামরিক শাসকের অধীনে শাসিত হতে থাকে। এবং সামরিক শাসকদের প্রতি সমর্থন জারি রাখে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন।
ওই সামরিক শাসকদের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্রকে মুছে ফেলা হয়। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। যদিও মুজিবকে ভারতের মিত্র বলে মনে করা হতো কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভুল করেননি। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে তিনি ভারতীয় সেনা পাঠাননি। যে কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তীতে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
এরপরও, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চলে। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান। তারপর যুক্তরাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে। পরে যুক্তরাষ্ট্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহম্মদ ইউনূসকে সামনে রেখে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়—যদিও তা সফল হয়নি।
সে সময় বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে ভারত। এ ব্যাপারে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে লিখেছেন কিভাবে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে জয় পেয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সমৃদ্ধির এক দশক দেখেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার সরকার যে সাফল্য দেখিয়েছে তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের এই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না করে কোনো উপায় থাকেনি। এমনকি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য এবং উন্নয়নের খবর ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনীতি, লৈঙ্গিক সমতা, সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
২০১৩ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে খোলাখুলিভাবেই মন্তব্য করেছিলেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দেয়।
এছাড়াও, বাংলাদেশ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিদেশ থেকে অনেক উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চলছে। ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটির জেফ রিচেলসন তদন্ত করে দেখেছেন, বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগকে সরানোর লক্ষ্য নিয়ে এরকম কিছু সংবাদমাধ্যমকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে এনইডি, যাদের অর্থায়ন করছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এসব থেকে বোঝা যায় হাসিনা সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তাই বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসম্যানের উদ্বেগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যে ড. কামাল হোসেন রাজনৈতিক জোট গঠন করছেন, তারই জামাতা ডেভিড বার্গম্যান এনইডি থেকে সহায়তা নিয়ে নেত্রনিউজ চালাচ্ছেন, যেখানে সরকারবিরোধী প্রচারণা করা হচ্ছে। তাই বলা যায়, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কখনো থেমে নেই।
অপরদিকে, চার দশক ধরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে এখন উগ্রবাদী তালেবান শাসন চলবে। পিলগার উল্লেখিত সেই জাতিধ্বংসের খেলার অংশ হিসেবেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও জঙ্গিবাদের পথে না হেঁটে জাতীয় সমৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এখন এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে, দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নেড়ে এখনো বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে সেই রাস্তা অনেকটাই প্রশস্ত হয়েছে।
এর মধ্যেই কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব হয়েছেন। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটেনের হাইকমিশনার। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণে ব্যবসার পরিবেশ নেই।
তো মানবাধিকারের পশ্চিমা অভিভাবকদের প্রতি প্রশ্ন রাখা যায়: যারা নারী শিক্ষা বন্ধ, মাদরাসা শিক্ষার নামে শিশুদের ওপর নিপীড়ন চালায় এবং ব্লাসফেমি আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায় তাদের সঙ্গে কী আপনাদের আলাপ হয়েছে?
২০১৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে কট্টরপন্থীদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের আলোচনায় যাওয়ার মানে হলো নিজেদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে সমঝোতা করা।
যদি পশ্চিমারা এখনো এটা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে—অত্যাচারী রাজতন্ত্রের সৌদি আরব কিংবা প্যারাসুট গণতন্ত্রের গানি-শাসিত আফগানিস্তানের চেয়ে ভূরাজনৈতিকভাবে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক চর্চার বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে—তাহলে তাদের ফের ৯/১১ এর মতো ঘটনা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সারাবাংলা/একেএম