ঘাতকরা চেয়েছিল কফিনসহ দাফন, বাধ সাধেন মসজিদের ইমাম
১৫ আগস্ট ২০২১ ০০:৫৫ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২১ ০৯:৩০
ঢাকা: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর সাধারণ মানুষ, দলের নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী- কাউকেই তার লাশের কাছে ভিড়তে দেয়নি ঘাতকরা। ১৫ আগস্ট ভোরে নির্মমভাবে হত্যার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরেই পড়ে ছিল বাংলার মহানয়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ।
অতঃপর ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জন্মভূমি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে তাকে দাফন করা হয় তার বাবার কবরের পাশে। সেনাবাহিনীর ওই হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শমশের আলী।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ পৌঁছানোর পর এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শেষ বারের মতো একনজর দেখার জন্য হাজার হাজার লোক ছুটে আসতে থাকে। কিন্তু নিজেদের রক্তাক্ত হাত ঢাকতে সেদিন কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল ঘাতকদল।
সেদিন জাতির পিতার কফিন হেলিকপ্টার থেকে নামিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ার তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, পোস্ট মাস্টার আনোয়র হোসেন, স্থানীয় মেম্বার আব্দুল হাই, সোহরাব মাস্টার, গেদু মিয়া, আকবর কাজী, মো. ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হকসহ এলাকার কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ। এরা টুঙ্গিপাড়া থানা সংলগ্ন হ্যালিপ্যাড থেকে কফিন বহন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যান।
ঘাতকেরা সেদিন চেয়েছিল কফিনসহ বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফন করতে। তারা স্থানীয়দের নির্দেশ দেন কফিনসহ দাফন করার জন্য। কিন্তু স্থানীয় মসজিদের ইমাম মৌলভী আব্দুল হালিম এতে ঘোর আপত্তি জানান। লাশ না দেখে কিছুতেই তিনি দাফন করতে দিচ্ছিলেন না। একজন মুসলমান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ইসলামী বিধি-বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান মৌলভী আব্দুল হালিম। এরপর সেনা অফিসাররা সব নিয়ম সেরে মরদেহ দাফনের জন্য সর্বসাকুল্যে ১৫ মিনিট সময় দেন স্থানীয়দের।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর কফিন খুলতে ডেকে আনা হয়েছিল ওই গ্রামেরই কাঠমিস্ত্রী হালিম শেখকে। আর তার সহযোগী ছিলেন তারই ১০ বছর বয়সী ছেলে আয়ুব আলী শেখ। হাতুড়ি ও চেড়া শাবল দিয়ে কফিন খুলে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তারা। গভীর শোকে তাদের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তখনও তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মারা গেছেন। কিছু সময়ের জন্য তারা স্তব্ধ হয়ে যান। অতঃপর সেনা সদস্যদের ধমক খেয়ে তারা ফের চেতন ফিরে পান। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দাফনে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবাই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন হাতে গোনা কয়েকজন।
দাফনে অংশ নেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল। গুলি বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাতেও গুলি লেগেছিল। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ। বঙ্গবন্ধুর মৃত শরীরের উপরেও বীভৎস নিপীড়ন চালিয়েছিল ঘাতকরা। যে তর্জনীর ইশারায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে ঢেউ তুলেছিলেন। ১৫ আগস্টের কালরাতে তাকে হত্যার পর তার তর্জনী কেটে দেয় ঘাতকরা।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ ভূ-খণ্ডের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহের গোসলটি হয়েছিল স্থানীয় আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে কিনে আনা ৫৭০ সাবান দিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী গোসল করিয়েছিলেন মন্নাফ শেখ, সোনা মিয়া ও ইমান উদ্দিন গাজী।
সাদাসিধে, অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ইতিহাসের এই মহানায়ক সব সময় সাদা সুতি পাঞ্জাবি-পাজামা আর কালো কোট পরতেন। শেষ বিদায়ে তার কাফনের কাপড়টি ছিল আরও সাদাসিধা, আরও অনাড়ম্বর! দেশের অসহায় মানুষের জন্য, দুঃস্থদের জন্য রেডক্রিসেন্ট থেকে পাঠানো ত্রাণের যে শাড়ি এসেছিল, সে শাড়ি কাপড় দিয়েই কাফন পরানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। সে শাড়ির জমিন ছিল সাদা আর পাড় ছিল লাল-কালো। সেই পাড় ছিঁড়ে ফেলে বঙ্গবন্ধুর কাফন হিসেবে পরানো হয়েছিল।
দাফন কাজ দ্রুত শেষ করতে সেনা কর্মকর্তারা জনসাধারণকে জানাযায় অংশ নিতে দেয়নি। দাফন কাজে টুঙ্গিপাড়া, পাটগাঁতী ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের মাত্র ৩০/৩৫ জন অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়া পৌঁছানোর আগেই সেখানে কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। জানাজা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম। টুঙ্গিপাড়াবাসী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছিল।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম