টানা বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রামজুড়ে জলাবদ্ধতা-পাহাড়ধস
২৯ জুলাই ২০২১ ১৯:৪৪ | আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২১ ০০:৩২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: লঘুচাপের প্রভাবে চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকায় অবিরাম বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এর ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কখনো সাময়িক, আবার কখনো দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়াও নগরীর বিভিন্নস্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে গত দুইদিনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত ১০৫ পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) বিকেল তিনটা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রাম নগরীতে ১৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া দফতর।
এ ব্যাপারে পতেঙ্গা আবহাওয়া দফতরের সহকারি আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল জানিয়েছেন, লঘুচাপের প্রভাবে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও ভারি বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে।
এদিকে, অবিরাম বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও, সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, কখনো মাঝারি, কখনো ভারি বৃষ্টির কারণে তিনদিন ধরে নগরীর বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জোয়ারের সময় নগরীর অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, নগরীর ডিসি রোড, বাকলিয়া তক্তারপুল, সিডিএ আবাসিক এলাকা, চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ থাকা দোকানপাটেও পানি ঢুকে পড়েছে। আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
অপরদিকে, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন পাহাড় থেকে ১০৫টি পরিবারকে সরিয়ে চারটি আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তাদের আল হেরা মাদ্রাসা, রউফাবাদ রশিদিয়া মাদ্রাসা, ফিরোজ শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লালখান বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আনা পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আজ (বৃহস্পতিবার) মতিঝর্ণা, ফিরোজশাহ ও আকবরশাহ এলাকার পাহাড় থেকে ২৫ টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।’
নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল জানিয়েছেন, লালখান বাজার এলাকার বিভিন্ন পাহাড় থেকে ৫০টি পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের ঘরগুলোতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।’
তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার পরও তারা সেখানে থাকছেন না। অনেকে আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে যাচ্ছেন। অনেকে আবার পুরনো ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারি পরিচালক নিউটন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নগরীর অন্তঃত পাঁচটি পাহাড় পরিদর্শন করেছি। সেখানে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। তাদের সরে যাবার জন্য মাইকিং করা হয়েছে।’
বিকেল ৪টার দিকে নগরীর গরীবউল্লাহ শাহ মাজার এলাকায় আমান উল্লাহ হাউজিংয়ে পাহাড় ধসে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের টিম সেখানে যায়। এর আগে সকালে আমবাগান এতিমখানা পাহাড় এবং বায়েজিদ লিঙ্ক রোডেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।
নিউটন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমান উল্লাহ হাউজিংয়ে যেখানে পাহাড় ধসে পড়েছে, সেখানে কোনো ঘর ছিল না। অদূরে একটি ঘর ছিল। সেখানে মাটি আসেনি। তবে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে সরকারিভাবে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি চট্টগ্রামে বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা করেছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রামে মোট ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে। এর মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়। বাকি সাতটি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার। এসব সংস্থার মধ্যে আছে- রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত বিভাগ, বন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের তালিকায় ১৭টি পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য চিহ্নিত করা হয়।
এরপর প্রায় ছয় কিলোমিটার বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ছোট-বড় ১৮টি পাহাড় কাটে। সেখানকার আটটি পাহাড়ে আছে কয়েক’শ অবৈধ বসতি। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম নগরী ও সংলগ্ন এলাকায় ২৫টি পাহাড়ে কয়েক হাজার পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে বলে ধারণা জেলা প্রশাসনের।
এর আগে, ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে বড় ধরনের মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটে। ওই বছরের ১১ জুন নগরীর কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবুবাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাপড়সহ সাতটি স্থানে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যায় শিশু-নারী ও বৃদ্ধসহ সব বয়সের ১২৭ জন।
পাহাড় ধসে ২০০৮ সালে মারা যায় ১২ জন। ২০১১ সালে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১৭ জন, ২০১২ সালে মারা যায় ২৩ জন। এভাবে প্রতিবছরই পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/একেএম