Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোরবানি কম, আড়তদারের ‘কারসাজিতে’ চামড়া সংগ্রহও কম

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২২ জুলাই ২০২১ ১৮:১৩ | আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২১ ১২:১৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনাকালের দ্বিতীয় ঈদুল আজহায় এবার চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের পরিমাণও কমেছে। চট্টগ্রামের আড়তগুলোতেসহ বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ চামড়া সংগ্রহ হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি। আড়তদারেরা জানিয়েছেন, গ্রামগঞ্জে আরও প্রায় সোয়া এক লাখ চামড়া লবণ দিয়ে স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা চামড়াগুলো আড়তে পৌঁছালে আড়তদারদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে দাবি তাদের।

বিজ্ঞাপন

প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, এবার চট্টগ্রামে গতবছরের চেয়ে পাঁচ শতাংশের মতো কম কোরবানি হয়েছে। এর ফলে চামড়ার পরিমাণ কমেছে। আবার আড়তদারদের কারসাজির কারণে চামড়ার দর অস্বাভাবিক কম হওয়ায় অনেকে বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আড়তদারেরা জানিয়েছেন, গতবারের চেয়ে এবার চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কম।

দেশে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু গত দুই বছর সঠিক দাম না পাওয়ায় বিক্রি করতে না পেরে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন সড়কে ফেলে গিয়েছিলেন সংগ্রহকারীরা। সেই পরিস্থিতি যাতে এবার না হয় এবং সংগ্রহ করা চামড়া যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য আগেভাগে তৎপর ছিল সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রশাসনের তদারকির পরও আড়তদারদের কারসাজির কারণে কাঁচা চামড়ার দর আর ঊর্ধ্বমুখী  হয়নি এবং যে পরিমাণ কোরবানি হয়েছে সেই পরিমাণ চামড়া সংগ্রহও হয়নি।

চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সেতু ভূষণ দাশ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে এবার ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৭৮টি পশু কোরাবানির প্রাথমিক তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে মহানগরীতে কোরবানি হয়েছে দুই লাখের মতো। গতবছর কোভিড শুরুর প্রথম বছরে চট্টগ্রামে প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার পশু কোরবানির তথ্য তারা পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার কোরবানি সে তুলনায় পাঁচ শতাংশ কমেছে।

কোরবানি কম হওয়া প্রসঙ্গে সেতু ভূষণ বলেন, ‘গতবছর কোভিডের মারাত্মক সংক্রমণের মধ্যেও বিত্তবান অনেককে দেখেছি ২-৩ টি এমনকি তার চেয়েও বেশি পশু কোরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তাদের অনেকে একটি দিয়েছেন। আবার যারা গতবছর একটি গরু কোরবানি দিয়েছিলেন, তাদের অনেকে এবার ভাগে দিয়েছেন। কোভিড শুরুর পর দ্বিতীয় বছরে এসে একটা প্রভাবের কারণে এমন হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায় নিয়োজিত ১১২ জন আড়তদার আছেন। চট্টগ্রামে ছোট-বড় ২২৫টি আড়তে চামড়া সংরক্ষণ হয়। চট্টগ্রামে একসময় ১৫-২০টি ট্যানারি থাকলেও এখন আছে শুধু একটি।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির হিসেবে, গতবছর কোভিডের কারণে কোরবানি কিছু কম হওয়ায় চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ কমেছিল। গতবছর তারা ৩ লাখ ৫৬ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এর আগের বছর ২০১৯ সালে পাঁচ লাখের মতো কাঁচা চামড়া চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবার আড়তদারেরা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা গতবছরের চেয়ে কমিয়ে সোয়া তিন লাখ নির্ধারণ করেছিল।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আড়তে আমরা দেড় লাখের কিছু বেশি চামড়া পেয়েছি। মাদরাসায় এবং অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ৫০ হাজারের মতো চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। সব মিলিয়ে দুই লাখের মতো চামড়ার তথ্য আমাদের কাছে আছে। তবে আমরা বিভিন্নভাবে খবর পেয়েছি, গ্রামগঞ্জেও লাখখানেক চামড়া আছে। সেগুলো লকডাউনের কারণে এখন আড়তে আসবে না। মাসখানেক পর আসবে। সব মিলিয়ে আমরা এবার সোয়া তিন লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করতে পারব বলে আশা করছি। আমাদের টার্গেটও ছিল সেটাই। কোরবানি কম হওয়ায় এবার চামড়া কম হয়েছে।’

নগরীর চৌমুহনী কর্ণফুলী বাজারের সামনে থেকে এবার ১২০০ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন আড়তদার মাহবুবুল আলমের প্রতিনিধি হাজী মোহাম্মদ দুলাল। তিনি সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গতবছর তিনি ৫ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এবার চামড়া কম আসায় প্রস্তুতি থাকার পরও তিনি বেশি চামড়া কিনতে পারেননি।

চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন সংক্রান্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির চট্টগ্রামের প্রধান হিসেবে আছেন চা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের আড়ত এবং মাদরাসায় মিলিয়ে দুই লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। ষোলশহর আলীয়া মাদরাসায় গিয়ে আমরা ২২ হাজার চামড়া দেখেছি। সেগুলো তারা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। আরও কিছু মাদরাসায় চামড়া আছে। তবে মফস্বলের হিসাব আমরা এখনও পাইনি। সেখানে স্থানীয়ভাবে কী পরিমাণ চামড়া সংরক্ষণ করা হচ্ছে, সেটা আমরা নেওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করছি, আগামীকাল (শুক্রবার) বেলা ১২টার মধ্যে আমরা পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাব। তবে কোরবানি কম হওয়ায় এবার চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ আমরা কম দেখতে পাচ্ছি।’

তবে চট্টগ্রামে এবার গতবছরের মতো সড়কে চামড়া ফেলে দেওয়ার পরিস্থিতি দেখা যায়নি। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার ভোরে আতুরার ডিপো এলাকায় বিক্রি করতে না পেরে দুই দফায় ২৫০ থেকে ৩০০ চামড়া ফেলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু চামড়া আড়তদরেরা এবং বাকি চামড়া নগরীর ষোলশহরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদরাসায় সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয়েছে বলে। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রেখেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম তদারকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর মোবারক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবার যেভাবে নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় চামড়া ফেলে দিয়েছিল, এবার সেরকম হয়নি। আমরা কাউকে চামড়া ফেলতে দিইনি। প্রয়োজনে সহযোগিতা করেছি। আতুরার ডিপোতে কিছু চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে গিয়েছিল। সেগুলো মফস্বল থেকে এসেছিল। আমি গিয়ে সেগুলো ষোলশহর মাদরাসায় দিয়েছি।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রধান রুহুল আমীন বলেন, ‘এবার আমরা চট্টগ্রাম শহরে চামড়া নষ্ট হতে দিইনি। কোরবানির আগে আমরা তিন দফা মিটিং করেছি। আমরা বলেছি, চামড়া হেফাজতে থাকলে সেটা নষ্ট করা যাবে না। অবশ্যই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। আতুরার ডিপোতে কিছু চামড়া আমরা পরিত্যক্ত অবস্থায় পেয়েছিলাম। আড়তদারের লোক এসে সেগুলো নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমরা তাদের দিয়ে দিই।’

প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসেবে, এ বছর পশু কোরবানির পরিমাণ ছয় লাখের বেশি। আর চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ যদি সোয়া তিন লাখের মতো হয়, তাহলে বাকি চামড়া কোথায় গেল, এমন প্রশ্ন উঠেছে।

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সেতু ভূষণ দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছয় লাখ কোরবানি হলে ছয় লাখ চামড়া সংগ্রহ হওয়ার কথা। কিন্তু যদি অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ হয়, তাহলে বাকি অর্ধেক নিশ্চয় নষ্ট হয়েছে। আমরা দেখেছি, চট্টগ্রামে নাকি মাত্র ২০০-২৫০ টাকায় চামড়া কেনা হয়েছে। ছাগলের চামড়া ফ্রি দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশনে দেখেছি, অনেকে সেই দামে চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। অনেকে ফেলে দিয়েছেন। এভাবে হয়ত কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে।’

দাম না পেয়ে কিছু চামড়া নষ্ট হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন আড়তদারেরা। এ জন্য তারা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের দায়ী করেছেন। আবার প্রাণিসম্পদ বিভাগ যত কোরবানির কথা বলছে, বাস্তবে কোরবানি তার চেয়েও কম হয়েছে বলে দাবি আড়তদারদের।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গরু, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে সোয়া তিন লাখের কিছু বেশি কোরবানি হয়েছে। কিছু চামড়া অবশ্যই নষ্ট হয়েছে, এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তবে শহরে হয়নি। মফস্বলে হয়েছে। কারণ, আমরা তো সেভাবে চামড়ার দাম দিতে পারিনি। ৩৫০-৪০০ টাকায় আমাদের চামড়া কিনতে হয়েছে। আমরা কি করব, ঢাকার ট্যানারি মালিকরা আমাদের টাকা আটকে রেখেছেন। এজন্য অনেক আড়তদার এবার চামড়া সংগ্রহ করেনি। আমাদের হাতে টাকা নেই। আমরা যতটুকু পেরেছি, ততটুকু দিয়ে কিনেছি। না হলে, আরও অনেক বেশি চামড়া নষ্ট হত।’

মুরাদপুর এলাকার মেসার্স এ আই লেদারের ব্যবস্থাপক আইয়ূব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে চট্টগ্রামের আড়তদাররা প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা পান। সেই টাকা যদি তারা পরিশোধ করতেন, তাহলে টাকাগুলো মার্কেটে যেত। তখন অনেক বেশি চামড়া সংগ্রহ করা যেত।’

আড়তদারের প্রতিনিধি হাজী মোহাম্মদ দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি। আমরা চামড়া কিনে লবণ দেওয়ার মানে হচ্ছে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়া। তারা জানে, চামড়া আমাদের তাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। অনেকে বলেন, আড়তদারদের সিন্ডিকেট। অথচ ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে আড়তদারেরা যে জিম্মি সেটা কেউ বলে না।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আড়তদারেরা ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করেন আর ট্যানারি মালিকরা করেন আড়তদারদের। আসলে এটা অভিনয়। তারা একই সিন্ডিকেটের। তারা দরপতন ঘটিয়ে মৌসুমি সংগ্রহকারীদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এজন্য এবার মৌসুমি সংগ্রহকারীরা সেভাবে চামড়া সংগ্রহ করেননি। ট্যানারি মালিকদের নির্দেশে আড়তদারেরা তাদের লোকজনের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এতে সব চামড়া সংগ্রহ করা যায়নি। অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। ট্যানারি মালিকরা তো দেশের বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। দেশ তাদের কাছে জিম্মি। আড়তদারদের নিয়ে তাদের কারসাজির কারণে দেশ বড় ধরনের রফতানির সুযোগ হারাল। কারণ যে চামড়া সংগ্রহ হয়েছে, তার চাহিদা দেশের বাজারেই আছে। সেখান থেকে সামান্য হয়ত রফতানি হতে পারে।’

উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের পর থেকে দেশে প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানি বন্ধ ছিল। ৩০ বছর পর সরকার এবার প্রথমবারের মতো এক কোটি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির আদেশ দিয়েছে।

সারাবাংলা/আরডি/একে

করোনা করোনা কোভিড ১৯ টপ নিউজ নভেল করোনভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর