১/১১’র নেপথ্যে কুশীলব কারা— ক্ষোভ আওয়ামী লীগে!
১৭ জুলাই ২০২১ ১৪:২৩ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২১ ১৭:৫০
ঢাকা: সেনা সমর্থিত এক/এগারোর নেপথ্যে দলের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের কুশীলব কারা? সেই কুশীলবরা কি এখনও সক্রিয় রয়েছে— এমন প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাই দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা।
শুক্রবার (১৬ জুলাই) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কারাবন্দি দিবসের আলোচনা সভায় ১/১১’র নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্রান্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী সভাপতিত্ব করেন।
সভায় বক্তব্য রাখেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম।
সভা পরিচালনা করেন মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীমসহ মহানগর দক্ষিণের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সেইদিন আর আসবে না। যারা এখনও এক/এগারোর রঙিন খোয়াব দেখছেন, সেই রঙিন খোয়াব বাংলাদেশে আর কোনোদিনও সফল হবে না।’
এক/এগারোর প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কিছু বর্ণচোরা রাজনীতিবিদ এবং উচ্চাভিলাষী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ষড়যন্ত্রে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই এদেশের গণমানুষের কণ্ঠস্বর আস্থার সোনালি দিগন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাবন্দি করা হয়। এর মাধ্যমে এদেশের গণতন্ত্রকে বন্দি করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এদেশের ইতিহাসে ওয়ান ইলেভেন একটি নিষ্ঠুর খোয়াব। এই খোয়াব তৈরি হয়েছিল বিএনপির হঠকারী ক্ষমতার রাজনীতি।’
এক/এগারোর সময়ে কারা নির্যাতিত ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেন থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। ওয়ান ইলেভেন আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য পাঠশালাস্বরূপ। বুঝতে হবে রাজনীতি মানে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো নয়। জনগণের জন্য নির্মোহ রাজনীতি করলে জনগণই পুরষ্কৃত করে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে জনগণের আকাশচুম্বী সমর্থন। আর যারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত ছিল। হাওয়া ভবন ছিল জনগণ তাদের ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেছিল। তার দায় এখনো সেই দলটি বয়ে বেড়াচ্ছে।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা এখনো বাংলাদেশে আছে। তারা এখনো দেশে বিশৃঙ্খলা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে আবারো ওয়ান/ইলেভেন সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। আমরা ভুলে যাইনি! কি অপমানজনকভাবে আমাদের নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার ঘর তন্ন তন্ন করে সেদিন তল্লাশি চালিয়েছিল। তার অসুস্থ স্বামী ড. ওয়াজেদকে পর্যন্ত তারা অপমান করেছিল। নেত্রীকে টানাহেঁচড়া করে আদালতে নিয়ে হাজির করেছিল। সে দৃশ্য বাংলার মানুষ দেখেছে। সেইদিন আর আসবে না। যারা মনে মনে ওয়ান/ইলেভেনের এখনো রঙিন খোয়াব দেখছেন, সেই রঙিন খোয়াব বাংলাদেশে আর কোনদিনও সফল হবে না। আপনাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হবে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্র যারা করছে তাদের সেই খোয়াব দেশের জনগণ সফল হতে দেবে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শেকড় আমাদের মাটির অনেক গভীরে। কোনো ষড়যন্ত্রেই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের দেশের জনগণ থেকে দূরে সরাতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না।’
বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের উত্তপ্ত নিশ্বাস, ক্রোধের নিশ্বাস, ওই নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটা ঠিকই বুঝতে পারছিল। বুঝতে পারছিল বলেই তারা কোনোমতে ছেড়ে দে মা কাইন্দা বাঁচি— এভাবে তারা জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কোনোরকম কারও অনুকম্পা নিয়ে নয়, কারও দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে নয়, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা জনগণের ভোটে জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সরকার গঠন করেন।’
এক/এগারোর সময়ে সারাদেশের নেতাকর্মীসহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলিষ্ট ভূমিকার কথা স্মরণ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সবসময় বলতেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাণ ভিত্তি হলো লাখ লাখ কর্মীরা। আপনারা সেদিন নেত্রীকে গ্রেফতারের পর যেভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, সেদিনেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝতে পেরেছিল হয়ত তাদের লক্ষ সফল হবে না। তারা নেত্রীকে মাইনাস করে এদেশে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। আমাদেরকে অনেক লোভ লালসা দেখিয়েছে। আমরা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে এই গুলশান বনানীতে অনেক মিটিং করেছি। তাদের এক কথা ছিল; শেখ হাসিনা মাইনাস, তোমাদের কে নেতা আছে আমরা তাকে সমর্থন দেব। আওয়ামী লীগকে আমাদের কোনো আপত্তি নেই কিন্তু শেখ হাসিনাকে দিয়ে হবে না।’
‘বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে বলেছিল আমাদের লক্ষ্য মাইনাস শেখ হাসিনা। কিন্তু আমরা সেদিন বলেছি, মাইনাস শেখ হাসিনা হলে বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি হবে না। শেখ হাসিনাকে রেখেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশে থাকবে। শেখ হাসিনাকে মাইনাস করে কোনো রাজনীতি এদেশে হতে পারবে না। তাই তারা সেদিন নানা ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। আজও ষড়যন্ত্র আছে। ধর্মান্ধ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা নানা ষড়যন্ত্র করছে। তার সঙ্গে কিছু মুখোশ পরা বুদ্ধিজীবী তারাও তাদের সঙ্গে আছে। তাদেরকে মোকাবিলা করার জন্য আমরা শপথ নেই। অতীতেও আমরা ব্যর্থ হইনি। আগামী দিনেও হবো না’ বলেন আব্দুর রাজ্জাক।’
নেতাকর্মীদের এক/এগারোর স্মৃতি স্মরণ করিয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ; এই বাংলাদেশে কাক ও কোকিল চেনা বড় দুষ্কর। সাদা আর কালো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বন্ধু এবং শত্রু কে? আমরা কিন্তু চিহ্নিত করতে পারছি না? কে আপন আর কে পর? তাও আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না? গণতন্ত্র অর্জন করা যত কঠিন, তার চেয়ে অনেক কঠিন গণতন্ত্রকে রক্ষা করা। নেত্রী ওই কারাগারে গিয়ে যখন আদালতে হাজির করে সেই আদালতে গিয়েও নেত্রী তার আদালতের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রেখেছিল,সেই বক্তব্য ছিল সেনা শাসকদের উপর একটি চপেটাঘাত। তার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাব। সামনে যত ষড়যন্ত্রই থাক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে আমরা এগিয়ে যাব। এই হোক আমাদের আজকের প্রত্যয়।’
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘কতিপয় সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ তাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়েছিল, তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে প্রকাশ্য দিবালোকে। সেদিন অনেক রাজনীতিক নেতা যাদেরকে আমরা পীরের চাইতেও বেশি শ্রদ্ধা করতাম। যাদেরকে আমরা পিতার চাইতেও শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম আমরা দেখেছি তাদের কি ভূমিকা? আমরা দেখেছি তারা কী করেছে? তারা সেদিন অনেকেই নেত্রীকে গ্রেফতার করার জন্যই তারা সেই ওয়ান ইলেভেনের সরকারকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়েছে এবং তারা বলেছে, যদি নেত্রীকে গ্রেফতার করা না হয় তাহলে আমরা কখনোই শান্তিতে দেশ শাসন করতে পারব না।’
ওয়ান/ইলেভেন সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল মাইনাস শেখ হাসিনা করে তারা দেশ পরিচালনা করবে। এটিই ছিল তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যের পক্ষে কারা কাজ করেছে? তারা কি সবাই আওয়ামী লীগের বিরোধী লোক? সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃবন্দদের একটি অংশ ছিল না? আজকে সেই ইতিহাস আমরা ভুলে যেতে শুরু করেছি। সেই ইতিহাস ভুললে চলবে না। কারণ এই ইতিহাস আমাদের মনে রাখতে হবে। অনেকেই অনেক কথা বলেছেম ভুলে গেলে চলবে না। কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
মির্জা আজম বলেন, ‘নেত্রী কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তখন অনেকের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তারা কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের বড় বড় পদধারী নেতা। মন্ত্রীত্বও পেয়েছেন। এই রকমও কিন্তু আছে। কিন্তু ওই সময় আমরা তাদের চেহারা কিন্তু দেখেছি। শেখ হাসিনা; তিনি বিশাল হৃদয়ের মানুষ। সবকিছু তিনি হজম করেন। আমরা কিন্তু এখনও বিভ্রান্ত হই।’
সারাবাংলা/এনআর/একে