যতক্ষণ ক্যামেরা, ততক্ষণ ‘লকডাউন’
৫ জুলাই ২০২১ ২২:৫৮ | আপডেট: ৬ জুলাই ২০২১ ০০:৪০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধিনিষেধ বা ‘লকডাউন’ শুরুর চারদিন পর এসে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সড়কে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যানবাহনের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারাই বলছেন, চট্টগ্রাম নগরীতে লকডাউন কার্যত থিতিয়ে পড়েছে। উপজেলাগুলোর অবস্থাও একইরকম।
নগরীতে দৃশ্যপট এমন হয়েছে যে. এলাকায় যতক্ষণ ‘মিডিয়ার ক্যামেরার’ উপস্থিতি থাকে, ততক্ষণ কঠোর ‘লকডাউন’ পরিস্থিতির দেখা মেলে। অন্যথায় পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক অন্যান্য সময়ের মতোই। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে, কাঁচাবাজারে মানুষের জটলা, মুখে অনেকেরই মাস্ক থাকে না। স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার তাগিদও নেই। আবার প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে লকডাউন কার্যকরে সমন্বয়ের অভাবও আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শিথিল অবস্থা চলতে থাকলে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণার কোনো সুফল মিলবে না।
সোমবার (৫ জুলাই) নগরীর তিনপুলের মাথা এলাকায় সকাল ৮টার দিকে দেখা গেছে, কয়েকশ’ মানুষের জটলা, হাঁক-ডাক। তাদের অনেকেই কাঁচাবাজারের-আড়তের পণ্য বহন ও খালাসে নিয়োজিত শ্রমিক। তাদের অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচাবাজারে দেখা গেছে, দোকানগুলোর সামনেও মানুষ। হাজারো মানুষ বাজার করছেন। সেখানে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কোনো কড়াকড়ি নেই প্রশাসন কিংবা বাজার কর্তৃপক্ষের।
পণ্য বহনে নিয়োজিত শ্রমিক মতিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তো কাজ করে খেতে হয়। কাজ না করলে খাব কী? গ্রামে পরিবার আছে। তাদের কাছে টাকা পাঠাব কীভাবে?’
কাঁচাবাজারে যাওয়া গৃহিণী আখতারি বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাই। কিন্তু বাজারে তো এগুলো মানা হচ্ছে না। এরপরও আমাদের তো বাজারে আসতে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে গোসল করে ফেলি। যতটুকু সম্ভব নিজে মানার চেষ্টা করি।’
নগরীর চেরাগি পাহাড় এলাকায় স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ জটলা হয়, কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জটলা তার চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চেরাগি পাহাড় থেকে জামালখান খাস্তগীর স্কুল পর্যন্ত আড্ডা-জটলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কয়েক দফা ধাওয়াও দিতে হয়েছে গত দুইদিনে। জটলা দেখা গেছে নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজার, হাজারী গলি, আসকারদিঘীর পাড়, পাথরঘাটা, কোতোয়ালির মোড়সহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়।
ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘চট্টলার চেরাগির’ অ্যাডমিন শৈবাল পারিয়াল সারাবাংলাকে বলেন, ‘চেরাগি পাহাড়ে বিভিন্ন দোকান ও বিল্ডিংয়ের নিচে কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীসহ শতাধিক মানুষের উপস্থিতি নিয়মিত থাকে। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর পর নিয়মিত যারা আড্ডা দেন তাদের উপস্থিতি তেমন নেই। বাইরে থেকে লোকজন এসে ভিড় করছে। এখানে চা, পান-সিগারেটের দোকান খোলা আছে। মোটর সাইকেল নিয়ে আসছে, চা খেয়ে আড্ডা জমাচ্ছে, সিগারেট কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চেরাগি পাহাড় থেকে খাস্তগীর স্কুল পর্যন্ত রাস্তায়-ফুটপাতে লোকজন বেশি ভিড় করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা মোবাইল পার্টির মাধ্যমে নিয়মিত লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পুলিশ চলে গেলে আবারও ভিড় করছে। পাড়াগুলোতে অহেতুক মানুষজন ভিড় করছে। আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছি।’
প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম তিনদিন কঠোরভাবে চট্টগ্রাম নগরী ও উপজেলায় বিধিনিষেধ চলছিল। গতকাল (রোববার) থেকে কিছু মানুষ বের হতে শুরু করে। সোমবার থেকে মানুষ এবং যানবাহন সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
নগরীর আগ্রাবাদ, বাদামতলী মোড়, টাইগারপাস এলাকায় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রিকশার পাশাপাশি প্রচুর মোটর সাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসও দেখা গেছে, যার সবগুলোতেই যাত্রী ছিল। মূল সড়কের আশপাশে শুধুমাত্র মুদি-ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকে। কিন্তু সড়ক পেরিয়ে গলিতে ঢুকলেই অন্যান্য দোকানপাট যেমন- লন্ড্রি, ফার্নিচার, হার্ডঅয়্যার, স্টেশনারি, সেলুনসহ বিভিন্ন দোকানপাটের কোনোটি আংশিক, কোনোটি পুরোপুরি খোলা দেখা যাচ্ছে। সামনের শাটার টেনে দিব্যি ব্যবসা করছে অনেকে। যেগুলো কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুবই নিম্নমানের মিথ্যা অজুহাত দিয়ে লোকজন রাস্তায় বের হচ্ছেন। একজনকে ধরা হলো, বললেন বাবার ক্যান্সার। বাবাকে ফোন করে জানা গেল পুরোটাই মিথ্যা। কেউ আবার বছরখানেক আগের চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হচ্ছেন। আমরা মানুষকে বোঝাচ্ছি, মাস্ক দিচ্ছি। এখন মানুষ যদি নিজে থেকে সচেতন না হয়, তাহলে তো পরিস্থিতি খারাপ হবে। আজ (সোমবার) একদিনে ১৬৪ জন মারা গেল। আমরা লোকজনকে বলছি এবং সতর্ক করছি।’
আবার কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় পড়লেও কলকারখানার বাইরে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নগরীতে চালু রাখা হয়েছে। প্রথমদিকে বন্ধ থাকলেও রোববার সপ্তাহের প্রথমদিনে ব্যাংকসংশ্লিষ্ট এসব প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বাধ্য হয়ে ঘর ছাড়তে হচ্ছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কলকারখানার বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান পেয়েছি যেগুলো চালু আছে। তাদের কর্মচারীরা ঘর ছেড়ে বের হলেও কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে পারে না। ধরলে বলে, আমার মালিকের সঙ্গে বা অফিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান জরুরি কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়। এখন আমরা ক’জনকে ধরতে পারি।’
সোমবার সকালে টাইগারপাসে র্যাবের চেকপোস্টের মাধ্যমে অভিযান হয়। সেখানে সাংবাদিক অথবা নামসর্বস্ব পত্রিকার স্টিকার লাগিয়ে যাত্রী পরিবহনের অভিযোগে কয়েকটি মোটর সাইকেল আটক করা হয়। র্যাবের চেকপোস্টে তল্লাশির সময় সেখানে বিভিন্ন মিডিয়ার কর্মীরা ছিলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক অভিযানের পর মিডিয়ার কর্মী কমতে শুরু করলে র্যাবের সদস্যরাও চলে যান। মুহূর্তেই সেখানে মানুষের আনাগোনা ও গাড়ি চলাচল বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকরে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, আনসার, নগর পুলিশ, জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের ১২টি টিম নগরীতে এবং ২টি করে টিম উপজেলায় কাজ করছে। প্রতিটি সংস্থাই স্বতন্ত্রভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে তাদের কার্যক্রমের সংবাদ প্রচারের জন্য সকাল থেকে অন্তত বেলা ১২টা পর্যন্ত মিডিয়া কর্মীদের উপস্থিতি থাকে। মিডিয়া কর্মীর সংখ্যা কমতে থাকলে কার্যক্রমও শিথিল হয়ে আসে, ‘লকডাউন’ও থিতিয়ে যায়।
বেলা ১২টার পর থেকে ‘লকডাউন’ শিথিল হলে লোকজন সড়কে বেরিয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আজ (সোমবার) থেকে সমস্যাটা হচ্ছে। প্রথম চারদিন এমন অবস্থা ছিল না। এজন্য আজ আমরা রেকর্ডসংখ্যক ৫২৯ জনকে জরিমানা করেছি। কাল (মঙ্গলবার) থেকে আমরা আরও কঠোর হব। সকাল ১০টায় সার্কিট হাউজ থেকে আমরা ১৬টা সংস্থা একযোগে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করব।’
চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ পথ সিটি গেইট ও শাহ আমানত সেতু এলাকায় দেদারসে ১/২ জন করে আরোহী নিয়ে মোটর সাইকেল চলছে। শহরতলীতে চলছে সিএনজি অটোরিকশাও। আবার বাসের সামনে গার্মেন্টসের স্টিকার লাগিয়ে উপজেলা থেকে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। নগরীতে ঢুকছে বিভিন্ন গণপরিবহনও।
শাহ আমানত সেতু এলাকায় সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকারী ক্যাপ্টেন আহসানুল করিম নাঈম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজনের গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন শহরে প্রবেশ করেনি বা করার চেষ্টাও করেনি। গত দুইদিনে পরিস্থিতি একটু পাল্টে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের। আজ (সোমবার) দুটি বাস পেয়েছি সামনে গার্মেন্টসের স্টিকার ছিল। অথচ ভেতরে তারা পটিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছিল। সেগুলোকে আমরা শহরে ঢুকতে দিইনি।’
বিধিনিষেধ কার্যকরে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কয়েকজন আলাপে তুলে ধরলেন সমন্বয়হীনতার কথা। তাদের মতে, ‘লকডাউনে’ আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মূল দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের। পুলিশকে সে অর্থে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এরপরও পুলিশ নগরীতে মহানগর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়টি প্রমাণ করা পুলিশের পক্ষে কঠিন। এ ঝামেলা এড়াতে পুলিশ আটক-গ্রেফতার এবং মামলা দেওয়া থেকে বিরত থেকে শুধুমাত্র লোকজনকে সচেতন করার জন্য কিছু কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো জিরো টলারেন্সে আছি। এটা সত্য যে, লকডাউন কার্যকরের মূল এখতিয়ার জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা তো কম। ফলে শুধুমাত্র ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে যত ধরনের কৌশল প্রয়োগ দরকার সেটা করছি।’
সমন্বয়হীনতার বিষয়টি নাকচ করে জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ সববাহিনী অথবা সংস্থাকে জোন ভাগ দেওয়া হয়েছে। যার যার অধিক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা আছে। সেনাবাহিনী কোথায় কাজ করবে, পুলিশ কোথায় করবে- এটা সুনির্দিষ্ট করা আছে। তবে একটা কথা হচ্ছে, মানুষ যতক্ষণ নিজে থেকে সচেতন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কিছুই করা যাবে না।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউন বা বিধিনিষেধ কার্যকরের দায়িত্ব তো আমাদের নয়, আমরা সর্বোচ্চ পরামর্শ দিতে পারি। লকডাউন শিথিল হয়ে পড়াটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ চলমান লকডাউনের প্রভাব আমরা এখন বুঝতে পারব না। এটা বুঝতে পারব ১৪ দিন পার হয়ে গেলে। কিন্তু লকডাউন শিথিল হয়ে গেলে আমরা যে ১৪ দিন পর ইতিবাচক প্রভাব বা সংক্রমণ কমে যাবার একটা আশা করছি, সেটা হয়তো সেভাবে না-ও মিলতে পারে। তখন এই লকডাউনে কোনো লাভ হবে না।’
ছবি: শ্যামল নন্দী, ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম