Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ঘরে চুলা জ্বলে না, তাই বাসে এসে বসে থাকি’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ জুলাই ২০২১ ২১:৫২ | আপডেট: ৩ জুলাই ২০২১ ২২:৩৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘আমরা দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ। গাড়ি চলে না, আমাদের ইনকামও নাই। ঘরে চুলা জ্বলে না। একবেলা খাবারও জোটাতে পারছি না। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বাড়িওয়ালার ঘর ভাড়ার তাগাদা। সেজন্য বাসে এসে বসে থাকি।’— কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর ৬ নম্বর লালদিঘী থেকে ফ্রিপোর্ট রুটে চলাচলকারী সিটিবাসের চালক গিয়াস উদ্দিন।

নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, কদমতলী বাস টার্মিনালে স্থায়ী ঠিকানার পাশাপাশি অসংখ্য বাস-মিনিবাস অলস বসে আছে নগরীর সিআরবি, টাইগারপাসসহ বিভিন্ন স্পটে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে বাসগুলোতে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন অনেক পরিবহন শ্রমিক।

বিজ্ঞাপন

গিয়াসের সঙ্গে কথা হয় নগরীর টাইগারপাস এলাকায়। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করোনা শুরুর পর থেকে কয়েক দফা গাড়ি বন্ধ করা হয়েছে। আমরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে চাই। কিন্তু মালিক গাড়ি বের করতে দেন না। সার্জেন্ট একবার গাড়ি ধরলে মামলা করে দেয়, ৫-৬ হাজার টাকা জরিমানা করে।’

সিআরবি এলাকায় অলস বসে থাকা কালুরঘাট-নিউমার্কেট রুটের সিটিবাসের চালক মো. আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসায় থাকলে বৌ-ছেলেমেয়েদের যন্ত্রণা। বাজার-সদাই করতে বলে। পকেটে টাকা নাই, কোত্থেকে করব। অনেক ড্রাইভার-হেলপার বাড়ি চলে গেছে। আমাদের বাড়ি দূরে, যেতে পারিনি।’

নিউমার্কেট এলাকায় যাত্রী ছাউনির নিচে বসেছিলেন হিউম্যান হলারের শ্রমিক আলম। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘লকডাউনে আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। আগেরবার ত্রাণ কিছু পেয়েছিলাম। এবার কেউ সাহায্য-সহযোগিতা করছে না। আমাদের নেতারাও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

চকবাজার এলাকায় কথা হয় সিএনজি অটোরিকশা চালক মো. হানিফের সঙ্গে। তিনিও জানালেন ‘লকডাউনে’ বেকার হয়ে অসহায়ত্বের কথা। স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।

বাসচালক মো. জহুর সারাবাংলাকে জানান, নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী একজন বাসচালক দিনে প্রায় দেড় হাজার টাকা ও সহকারী কমপক্ষে ৭০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু দুইবেলা ভাত-হাতখরচ শেষে দিনে বাসায় নিতে পারেন আয়ের অর্ধেকের মতো। রমজান মাসের আগে-পরে প্রায় দুই মাসের মতো বাস চলাচল বন্ধ ছিল। অধিকাংশ শ্রমিকই সঞ্চয়ী নন বা সঞ্চয় করার মতো অর্থ তারা উপার্জন করতে পারেন না। এজন্য পরিবহন শ্রমিকদের কষ্টটা বেশি।

১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণার পর সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ আছে। তবে পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কঠোর বিধিনিষেধের শুরুর তিনদিন আগে থেকেই গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সে হিসেবে গত ছয়দিন ধরে তারা কার্যত বেকার আছেন। কিছু কিছু কলকারখানা বাস-টেম্পু, হিউম্যান হলার ভাড়া করে তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের আনা-নেওয়া করছেন। সেখানে মোট পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে পাঁচ শতাংশেরও কাজ জোটেনি বলে জানান তারা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মুছা সারাবাংলাকে জানান, চট্টগ্রাম মহানগরী ও উত্তর-দক্ষিণ, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও আশপাশের বিভিন্ন জেলাসহ মোট ৯৬টি রুটে চলাচলরত গণপরিবহনে প্রায় ৭৫ হাজার শ্রমিক আছেন। এর মধ্যে বাসশ্রমিক আছেন ২৭ হাজারের মতো। চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত গণপরিবহনের শ্রমিক আছেন প্রায় ৫ হাজার।

ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি) চট্টগ্রাম জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক রাহাতউল্লাহ জাহিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত রমজান মাসসহ প্রায় দুই মাস বাসসহ অধিকাংশ গণপরিবহন লকডাউনের কারণে চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। এর ফলে দুই মাস বেকার ছিলেন শ্রমিকরা। কারণ ৯০ শতাংশের ওপর শ্রমিক দৈনিক আয়ের ওপর চলেন। দূরপাল্লার কিছু বড় কোম্পানির বাসের শ্রমিকরা মাসিক বেতন পান, তাদের সংখ্যা ১০ শতাংশও হবে না। এই যে লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে এসব দৈনিক আয়ে চলা পরিবহন শ্রমিকরা কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে সরকারের কোনো সঠিক চিন্তা বা পরিকল্পনা আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি থাকত, তাহলে পরিবহন শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের কথা ভেবে একটা বাস্তবসম্মত উপায় বের করতো। এই শ্রমিকরা এখন ধার-দেনায় বিপর্যস্ত, তাদের পরিবারের সদস্যরা অভুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করছেন। আমরা প্রতিনিয়ত তাদের সংকটের কথা শুনছি, সরকার-প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি, কিন্তু সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই।’

পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ মুছার মতে, সীমিত কিংবা কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হলেও সীমিতভাবে গণপরিবহন চালু রাখা দরকার। তিনি বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য একমাত্র পরিবহনই দায়ী, এটা সঠিক নয়। তাহলে দুইমাস গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও কেন করোনার সংক্রমণ এত বেড়ে গেল? ঈদের সময় গণপরিবহন বন্ধ ছিল, কিন্তু মানুষের বাড়ি যাওয়া কি ঠেকানো গেছে? মানুষ মোটর সাইকেলে করে, নৌকায়-লঞ্চে, গাদাগাদি করে ফেরি পার হয়ে বাড়িতে গেছে। সে কারণেই সংক্রমণ বেড়েছে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু রাখলে এই সমস্যাটা হতো না।’

কঠোর বিধিনিষেধে জনজীবনে কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও গতবছরের মতো ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা এবার চট্টগ্রামে দেখা যাচ্ছে না। সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু গতবারের মতো সংগঠন ও ব্যক্তিউদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা তেমন দৃশ্যমান নয়।

শনিবার (৩ জুলাই) চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদের উদ্যোগে প্রায় ৬০০ সিএনজি অটোরিকশা চালককে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। সহায়তার মধ্যে আছে- চাল, ডাল, তেল, লবন ও চিনিসহ ২৫ কেজি নিত্যপণ্য।

একইদিন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত ও অতিবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত ২৭৮ পরিবারের প্রতিটিকে এক হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়। লকডাউনের মধ্যে অসহায় হয়ে পড়া পরিবারগুলোকে পর্যায়ক্রমে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান।

পরিবহন শ্রমিকদেরও দ্রুত খাদ্য সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়ে টিইউসি নেতা রাহাতউল্লাহ জাহিদ বলেন, ‘২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পুলিশ তালিকা নিয়ে একটি ডাটাবেইজ তৈরি করেছিল। সেই ডাটাবেইজ ধরে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছিল। এবারও একই ডাটাবেইজের ভিত্তিতে জরুরি খাদ্য ও নগদ টাকা দিয়ে শ্রমিকদের সহায়তা করার দাবি জানাচ্ছি।’

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

কঠোর বিধিনিষেধ চট্টগ্রাম টপ নিউজ বাস শ্রমিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর