দেশে ষাটোর্ধ্ব ১২ জনে একজন ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন: গবেষণা
১ জুলাই ২০২১ ১০:১৭ | আপডেট: ১ জুলাই ২০২১ ১৫:৫২
ঢাকা: দেশে ৬০ বছর বয়সী এবং এর চাইতে বেশি বয়সীদের প্রতি ১২ জনের মাঝে একজন ব্যক্তি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। এর মধ্যে পুরুষদের চাইতে মহিলাদের ডিমনেশিয়া’র প্রকোপ ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে খুব বেশি প্রার্থক্য দেখা না গেলেও দেশে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজশাহী ও রংপুরে ডিমনেশিয়ার প্রকোপ সবচাইতে বেশি। ষাটোর্ধ্বদের মাঝে যারা কখনও স্কুলে যাননি ও যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই তাদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ অন্যদের চাইতে বেশি দেখা গেছে ।
বুধবার (৩০ জুন) আইসিডিডিআরবি ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের যৌথ সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার ব্যাপকতা: জাতীয় সমীক্ষার ফলাফল’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ তথ্য জানানো হয়।
ডিমেনশিয়া এমন একটি সিনড্রোম, যে ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের কাজ শেষ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে এবং এর ৬০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে খুব কম তথ্য রয়েছে। তথ্য কম থাকার কারণে দেশের প্রবীণ নাগরিকদের সেবা প্রদানে নীতি নির্ধারকদের একটি বাস্তবমুখী কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অন্যদিকে, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশিরভাগ প্রোগ্রাম প্রজননক্ষম বয়সের মানুষকে কেন্দ্র করে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
ওয়েবিনারে জানানো হয়, বাংলাদেশে সাতটি বিভাগে ২০১৯ সালে আইসিডিডিআরবি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স শহর ও গ্রাম মিলিয়ে দুই হাজার ৭৯৬ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে এই জরিপ চালায়। সেখানে দেখা যায়, প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়াতে আক্রান্ত। এক্ষেত্রে ৮ শতাংশ হারে ডিমেনশিয়ার প্রভাব পাওয়া যায়। নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ শতকরা দুই দশমিক ৫ গুণ বেশি।
গবেষণায় অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজশাহীতে ১৫ শতাংশ এবং রংপুরে ১২ শতাংশ ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বেশি। একইসঙ্গে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কখনও স্কুলে যাননি এবং যাদের স্ত্রী বা স্বামী নেই সামগ্রিকভাবে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকেরও বেশি হাইপার টেনশন (৫২ শতাংশ), হতাশা (৫৪ শতাংশ), এবং ডায়াবেটিসসহ (৮ শতাংশ) এক বা একাধিক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা (মাল্টিমর্বিডিটি) ছিল।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি পুষ্টির অভাব (৩৫ শতাংশ কম ওজন), স্বল্প শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (৪৯ শতাংশ), উচ্চমাত্রায় লবণ গ্রহণ (৫৬ শতাংশ) এবং উচ্চমাত্রায় তামাক সেবন (৭৬.৬ শতাংশ) করতে দেখা গেছে যা সাধারণত নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা এনসিডি ঝুঁকির কারণ।
গবেষণায় জানানো হয়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশেরই গত ৬ মাসে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মাঝে ১২ শতাংশ চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ও ৫.৪ শতাংশ সরকারি হাসপাতালের যোগ্য ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসার চাইতে বেশি গেছে ওষুধ বিক্রেতার কাছে। এই হার প্রায় ১৬.৬ শতাংশ। এই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ধরনটি রোগীদের লিঙ্গভিত্তিক, বসবাসের স্থান (নগর বা গ্রামীণ অঞ্চল) ভিত্তিক কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি।
সমীক্ষায় অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে ০.২৮ মিলিয়ন পুরুষ এবং ০.৮৮ মিলিয়ন নারী। একইসঙ্গে গবেষণা দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১.৩৭ মিলিয়নে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে (২.৪ মিলিয়ন)। যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, বেসরকারি এবং সরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি এদেশে একটি উদ্ভাবনী স্থানীয় প্রমাণ ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কমানো যাবে।
ওয়েবিনারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আইসিডিডিআরবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ এবং ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওয়েবিনারের সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
এই গবেষণার গুরুত্ব সম্পর্কে জানিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল এর পরিচালক এবং গবেষণার কো-পিআই অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ উল্লেখ করেছেন, সমাজের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তাই খুব বিলম্বে রোগ নির্ণীত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগী হয়ে আমাদের ডিমেনশিয়া নিয়ে আরও গবেষণা চালানো দরকার, যেন আমরা ডিমেনশিয়া বৃদ্ধির কারণ সনাক্ত এবং এটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেছেন, বিশেষত বহু রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তবুও, আমাদের কাছে প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সামগ্রিক পরিষেবা মডেল নেই। তাই সরকারি, বেসরকারি এবং গবেষণা সংস্থার প্রচেষ্টায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
আইসিডিডিআরবি’র ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ইউনিটের প্রধান, এবং গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. আলিয়া নাহিদ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
গবেষণা সম্পর্কে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ নাগরিকের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি এবং ডিমেনশিয়ার প্রকোপ অনুমান করেছি। বার্ধক্য অনস্বীকার্য, এজন্য বয়স্ক ব্যক্তির যত্নকে কেন্দ্র করে সহানুভূতিশীল সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণার তথ্য-উপাত্তগুলো প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল পদ্ধতির বাইরে এক বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেল তৈরি করতে সহায়তা করবে।
তিনি আরও বলেন, এটি একটি জীবনচক্রীয় পদ্ধতির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যবস্থাগুলো সংহত করতে এবং অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং বার্ধক্য বয়সে ডিমেনশিয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা মোকাবিলায়ও সহায়তা করবে।
সারাবাংলা/এসবি/এসএসএ