বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া
৭ জুন ২০২১ ২৩:০১ | আপডেট: ১১ জুন ২০২১ ১৭:৩৯
ঢাকা: প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারপারসন ড. আতিউর রহমানের। তবে এই বরাদ্দ ব্যয়ের বিষয়টি মনিটরিংয়ে জোর দিতে বলছেন তিনি। আর প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কেনার বিষয়টিকে। কেননা অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করছেন তিনি। সেটি কত দ্রুততম সময়ে দেওয়া যায়, সেদিকেই মনোযোগী হতে আহ্বান জানিয়েছেন ড. আতিউর।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে অন্তত ১০ কোটি মানুষকে দেওয়া। আর সেটি বেশ তাড়াতাড়ি দিতে হবে। ভ্যাকসিন যেখানেই পাই, যে দামেই পাই না কেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সংগ্রহ করে ১০ কোটি মানুষকে দিতে হবে। এটিই হবে প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও টাকা লাগলে টাকা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে টাকা কোনো সমস্যা না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভ্যাকসিন কোথায় পাওয়া যাবে, কবে নাগাদ পাওয়া যাবে।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সোমবার (৭ জুন) সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এই বাজেট ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় জনবান্ধবও বটে বলে মন্তব্য তার।
বাজেটে ভ্যাকসিন কেনার জন্য বরাদ্দ রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ করার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, সরকার এরই মধ্যে রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে যোগাযোগ করেছে। তারা আশ্বাসও দিয়েছে। আমরা আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন পাব। তবে এত ভ্যাকসিন পেতে সময় লাগবে। আবার আমরা সময়ও বেশি দিতে পারছি না। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা অন্তত দ্রুত সময়ের মধ্যে শহর ও সীমান্ত এলাকার জনগণের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় রকমের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে।
ভ্যাকসিন প্রয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. আতিউর বলেন, বাজেটের অর্থ বরাদ্দ দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। বাজেটের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের মনে একটা স্বস্তি দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। সেটি করতে হলে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন দিতে হবে। যদি ঠিকমতো ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারে। তাই আমাদের মূল নজরটা দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতের দিকে। স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যেসব দুর্বলতার কথা আমরা শুনি, সেগুলো পূরণ করার দিকে নজর দিতে হবে। শুধু টাকা দিলে হবে না, স্বাস্থ্য খাতের প্রতি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় জোর দেওয়া হলেও অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটকে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার বাজেট হিসেবে অভিহিত করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, এবারের বাজেটটি একটি সর্তক বাজেট। আমাদের এই সময়কার কোভিড সংকট, আমাদের সক্ষমতা, আর্থিক অবস্থা— সবকিছু মাখায় রেখে এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে। বাজেটে দুর্যোগ মোকাবিলারটি বিষয়টিতে জোর দেওয়া হলেও এটি কিন্তু সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার বাজেট। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধি যেন ব্যাহত না হয়, সেজন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগের ওপরও নজর রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেদিক বিবেচনা করলে জীবন ও জীবিকা— দুই দিকেই বাজেটে নজর দেওয়া হয়েছে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ আমাদের তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের বিনিয়োগ পাবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। আগামী তিন মাসে আরও বেশি চাহিদা তৈরি হবে। এরই মধ্যে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলতে শুরু করেছে। মানুষের চাহিদা ও আয় রোজগার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সেসব দেশে চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণ করতে আমাদের দেশে বড় বড় অর্ডার আসবে।
কোভিড সংক্রমণের সময়েও আমাদের দেশের তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার কারখানাগুলো ঝুঁকি নিয়েও চালু রেখে বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এতে অনেক অর্ডার আসছে এবং আসবে। সেগুলো সরবরাহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এতে এ বছর আমাদের রফতানি আয় বড় ধরনের জাম্প করতে পারে।
করোনাকালেও সরকার প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটি অর্জন করা সম্ভব বলেও মনে করেন ড. আতিউর রহমান। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও কৃষি— এই তিনটি খাতকে প্রধান নিয়ামক মনে করছেন তিনি।
ড. আতিউর বলেন, প্রবাসী আয় প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলার করে বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটেও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকবে। আমাদের কৃষি বরাবরই ভালো করছে। এবারও ভালো করছে এবং আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে। ফলে আমাদের অর্থনীতির প্রধান তিনটি স্তম্ভ— তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আয় ও কৃষি খাত— এই তিনটিই বর্তমানে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা না করলেও হবে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার যেটা আশা করছে, আমার মনে হয় আমরা তার কাছাকাছি চলে যাব।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া কিংবা দরিদ্র হয়ে পড়া লোকদের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু নেই— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কারা চাকরি হারিয়েছেন কিংবা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, সেই ডাটাবেজ আমাদের নেই। ফলে এদের অনেককে সাহায্যে করা সম্ভব হবে না। চাকরি হারানো লোকদের ডাটাবেজ থাকলে তাদের সহায়তা করা যেত। ফলে এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। বরং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে চাকরি হারানো লোকেরা নতুন করে চাকরি পাবেন। অনেকে হয়তো তাদের সেক্টর বদল করবেন, কেউ কেউ আবার উদ্যোক্তা হবেন। তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মনে করছেন ড. আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার খাতে এক লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও কৃষি খাতেও বরাদ্দ বেড়েছে। ব্যবসা খাতেও বেশ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আগামী দিনে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং দেশীয় শিল্প বিকাশের জন্য বাজেটে ব্যবসায়ীদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এ কারণে এই বাজেট ব্যবসাবান্ধব। বাজেট ব্যবসাবান্ধব হওয়ার কারণে এটি জনবান্ধব বাজেটও বটে। কারণ বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেন।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর