Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ব্যয়ে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২ জুন ২০২১ ২২:২৫ | আপডেট: ৩ জুন ২০২১ ১১:৫২

ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব বেড়েছে। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্ধ বাড়ানোর পাশাপাশি তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিতে হবে সঠিক পরিকল্পনা। সরকারও সেই লক্ষ্য নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাজেট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সাত অর্থবছরের কোনোটিতেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। তবে আসছে বাজেটের ৭ শতাংশেরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এই খাতে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। আর এই বরাদ্দে এবার গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসকদের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়ানোর বিষয়টি। একইসঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন নিয়োগের পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার জন্যও বরাদ্দ থাকছে বাজেটে। পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া হতে পারে পারে ঝুঁকি ভাতাও।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই নেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতকে ঘিরে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া বাজেট পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয় করার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে যারা আছেন, তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এই খাতকে শক্তিশালী করতে নতুন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের ভাবনাও রয়েছে। এর জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

সূত্রে জানায়, করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসকদের এককালীন সম্মানি ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই বাজেটে চিকিৎসকদের সম্মানি ভাতার জন্য বরাদ্দ থাকছে ১০০ কোটি টাকা। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এ ভাতার পাশাপাশি দেওয়া হতে পারে ঝুঁকি ভাতাও। সেইসঙ্গে আসতে পারে প্রণোদনার ঘোষণা। প্রণোদনা ও এসব ভাতার জন্য আগামী বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকছে ৮৫০ কোটি টাকা।

সূত্র আরও জানায়, চলতি বাজেটে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়াতে বরাদ্দ রয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক সেবা ও অনলাইনে বিশেষায়িত সেবা দিতে বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। এছাড়াও স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ অর্থ ব্যবহার করা যায়নি। এর জন্য তারা দায়ী করছেন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবকে। তারা বলছেন, দেশে কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেড় শতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেলেও তাদের ক্ষতিপূরণ না দিতে পারাটা ছিল অমার্জনীয় ব্যার্থতা। আর সে কারণেই নতুন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর তথ্যকে তারা স্বাগত জানালেও এই বরাদ্দ খরচের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি যথাযথ মনিটরিং প্রয়োজন বলেও মত তাদের।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, দেশে করোনা মহামারির মধ্যেও কিন্তু অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই এখন সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন আছে। একইসঙ্গে বাড়ানো হয়েছে আইসিইউ। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা এখন প্রায় সবখানেই আছে। জনবল নিয়োগের বিষয়ে কিছু জটিলতা থাকলেও সেগুলো সমাধান করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে বলেছেন। সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অনেক হাসপাতালেই কিন্তু এসব অর্থছাড় দেওয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আরও কাজ করা হবে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আমরা স্বাস্থ্য খাতের বাজেট করছি।

বরাদ্দ ব্যয়ে কার্যকর পরিকল্পনা ও দক্ষ জনবল তৈরির তাগিদ

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান সারাবাংলাকে বলেন, দেশে প্রতিবারই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি জানানো হয়। এটি যৌক্তিকও। কিন্তু বরাদ্দ বাড়ালেও দেখা যায় খরচ করা যায় না। এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া অর্থ ব্যয় করার সক্ষমতা তৈরির জন্য এখন পর্যন্ত কতজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেটি জানা প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশে এখনো অনেক চিকিৎসক কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রকল্পের প্রধান হিসেবে কাজ করলেও তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে দেখা যায় প্রকিউরমেন্ট আইন জানা ও প্রকল্প তৈরি করার অভিজ্ঞতা খুব বেশি কর্মকর্তার নেই।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিন্তু অন্য দশটি মন্ত্রণালয়ের চেয়ে আলাদা। এটি একটি টেকনিক্যাল বিভাগ। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো এখানে চাইলেই টাকা ব্যয় করা যাবে না। আর তাই প্রয়োজন পরিকল্পনার সঙ্গে এগুনো। একইসঙ্গে মনিটরিং করা।

ডা. কামরুল হাসান বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণকালে সেবা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর তাদের ক্ষতিপূরণসহ চিকিৎসকদের প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। যারা চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদেরও তো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। অথচ সেই বাবদ কিন্তু বরাদ্দ ছিল মন্ত্রণালয়ে। তাহলে দিতে পারল না কেন? এর কারণ সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব। যারা এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা কেন পারলেন না, সেই জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এগুলো মন্ত্রী ও সচিবদের করার কথা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অনেক কিছুই মনিটরিং করতে হয়। এখন এই প্রণোদনা বিষয়েও যদি তাকেই খেয়াল রাখতে হয়, তাহলে এত মন্ত্রী, সচিব, পরিচালক রেখে আর লাভ কী?

নতুন বাজেটে প্রত্যাশা কী— জানতে চাইলে বিএসএমএমইউয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, আগামী বাজেটে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সমানুপাতিক হারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট ও কর্মচারী নিয়োগের নির্দেশনা থাকতে হবে। একইসঙ্গে বাজেটের বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহারের জন্য জনবান্ধব, চিকিৎসাবান্ধব আধুনিক ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন করতে হবে। প্রতিটি কর্মসূচির নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও ফলোআপের আধুনিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বিভিন্ন বিভাগের নিবিড় সমন্বয় থাকতে হবে। কাজের সুষ্ঠু বণ্টন ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

অধ্যাপক কামরুল বলেন, চিকিৎসক ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে আগামীর বাজেটে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও কঠোরভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য কঠোরভাবে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নার্স ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশনের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও আগামীর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য গবেষণার সুযোগ, পরিবেশ বাড়াতে হবে।

টেলিমেডিসিন সেবা নিয়ে পরিকল্পনা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সবাই কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু এর জন্য তো নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত করা যাবে না। আর তাই দেশে টেলিমিডিসিন সেবাসহ প্রান্তিক পর্যায়ে সবাই যেন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসতে পারে, তার পরিকল্পনা করতে হবে। এসব পরিকল্পনার প্রতিফলনই দেখতে চাই বাজেটে। আর বাজেটে দেওয়া সেই বরাদ্দ যেন পরিকল্পনামাফিক খরচ করা যায়, সেজন্য মনিটরিং ব্যবস্থাপনাও জোরদার করার উদ্যোগ দেখতে চাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিভাগে বিশেষজ্ঞ তৈরি করার প্রক্রিয়া পরিকল্পিত না। আর তাই দেখা যায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা ব্যয় করতে পারে না। এর কারণ বাস্তব চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রস্তুত করেন না স্বাস্থ্য খাতের বাজেট তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। দেখা যায় আগের অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পরের বছরের বাজেট তৈরি করেন। আর তাই পরিকল্পনা নিয়ে বাজেট না করতে পারাতে অর্থ থেকে যায় অব্যয়িত। এজন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বরাদ্দ দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। এটি বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে। একদিকে দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য যেমন বরাদ্দ বাড়াতে হবে, তেমনি সেই বরাদ্দ বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ লোকবল তৈরি ও বাস্তবায়ন কিভাবে বাড়ানো করা যায়, সেই নীতি গ্রহণ করতে হবে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বাজেট ২০২১-২২ বাজেট স্পেশাল ২০২১-২২ স্বাস্থ্য খাত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ

বিজ্ঞাপন

লন্ডনের পথে খালেদা জিয়া
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৯

আরো

সম্পর্কিত খবর