অতলান্তিক পেরিয়ে পর্ব ৩
২১ মে ২০২১ ১১:৫২ | আপডেট: ১৮ জুন ২০২১ ১৪:৪২
ঢাকা থেকে আমরা অনেকবার কক্সবাজার গেছি বাসে চড়ে। প্লেনেও গেছি এক দু’বার। তবে রাতের বাস জার্নি আমার বেশি ভালো লাগে। কয়েক ঘণ্টা পর কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি হতো। এই যাত্রাবিরতিটা খুব এনজয় করতাম। কুমিল্লায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখা যেত বহ্নি ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে জাগিয়ে তুলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসতাম। তারপর চা খাওয়া হতো। চা খেতে খেতে আশপাশের অনেককে দেখতাম বুভুক্ষের মত ডাল-পরোটা খাচ্ছে। মানুষজন আরাম করে কিছু খাচ্ছে এই দৃশ্য ক্ষুধা উদ্রেককারী। ওদের খাওয়া দেখে আমারও খিদে পেয়ে যেত। তাই ডাল-পরোটার অর্ডার দিতাম। পরোটা ডালে ডুবিয়ে মুখে দিয়ে মনে হত এই রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির জন্ম হয়েছে পরোটা আর ডাল বানানোর জন্য। সে যদি অন্য কিছু বানায় তাহলে এতো ভাল বানাতে পারবে না। আমি খুব আয়েশ করে খেতাম, আর বহ্নি পুরোটা সময় আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত যেন ডাল-পরোটা না, বিষাক্ত কিছু খাচ্ছি আমি। রন্ধন আর হাইজিন এই দুই বিষয়ে তার সেন্সিটিভিটি খুব প্রবল। রাস্তার পাশের হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে চা খাওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে, তবে এর বেশি কিছু ওর জন্য না। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুলগামী ফ্লাইট TK713-তে চড়ে আমাদের কক্সবাজারের সেই রাতের বাস জার্নিগুলো আমি মিস করতে থাকলাম। যারা কখনও আকাশ ভ্রমণের সুযোগ পায়নি তাদের হয়ত ধারণা হতে পারে প্লেন জার্নি খুব মজার একটা ব্যাপার। আমার কাছে এটা কেমন মনে হয় বলি। আমার মনে হয় একটা প্লেনে চড়ে মাটি থেকে চল্লিশ হাজার ফুট উপরে উঠে দশ মিনিট চক্কর খেয়ে যদি মাটিতে নেমে আসতে পারতাম তাহলে ব্যাপারটা আনন্দেরই হত। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে থাকাতে কোনো আনন্দ নেই। লম্বা জার্নিতে আমার মাথা ধরে লিখেছিলাম। যথারীতি মাথা এবারও ধরেছে। আমার পাশের রো’তে চার-পাঁচ বছরের এক বাচ্চা প্লেন ছাড়ার পর থেকে কিছুক্ষণ পরপর কাঁদছে। সিঙ্গেল সিলেবলের কান্না। কান্নায় ব্যবহৃত শব্দটা হচ্ছে “এএএএএ…”। এই এক অক্ষরের কান্না অনেকক্ষণ থেকে শুনছি। নিজের অজান্তেই “এএএএএ…” এর পরে বিড়বিড় করছি “বিইইইইই…”, “সিইইইইই…”। তাতে যদি মাথা ধরাটা যায়।
আমার ভাগ্যে জার্নিতে বাচ্চার কান্না খুব কমন একটা ব্যাপার। শুধু প্লেনে না। বাসে কিংবা ট্রেনে চড়েও যদি আমরা কোথাও যাই, দেখা যায় আমাদের পাশে একটা বাচ্চা পড়বে। এবং নিশ্চিতভাবে পুরো জার্নিতে বাচ্চা তার গলায় যে জোর আছে সেটা সবাইকে জানানোটা অবশ্যকর্তব্য মনে করবে।
প্লেনে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই কেবিন ক্রুরা কিছু এক্সেসরিস দিয়ে গিয়েছিল। দেখার সুযোগ পাইনি। এখন হাতে নিয়ে দেখলাম জ্যামিতি-বক্সের মতো দেখতে একটা টিনের কৌটা। খুলে দেখি ভেতরে টুথব্রাশ, মোজাসহ আরও কিছু টুকিটাকি। এছাড়া ছোট্ট একটা প্যাকেটে একজোড়া কটন-স্লিপার দিয়েছে। লম্বা জার্নিতে জুতা পরে থাকতে অনেকের বিরক্ত লাগে। তখন চাইলে এগুলো পরে বসে থাকা যায়। আমার মজা লাগল টিনের কৌটাটা দেখে। কৌটার উপরে পৃথিবীর একটা ম্যাপ প্রিন্ট করা। ভাল মতো তাকিয়ে দেখি এটা সেই বিখ্যাত পিরি রেইসের ম্যাপ। পিরি রেইসের ম্যাপ নিয়ে একটু বলি। ১৯২৯ সালে টোপকাপি প্যালেস লাইব্রেরিতে পুরানো জিনিসপত্রের নিচে একটা ম্যাপ খুঁজে পাওয়া যায়। হাতে আঁকা পৃথিবীর ম্যাপ। তাও আবার পুরোটা না, তিনভাগের একভাগ মাত্র।
ম্যাপের লেখা আর অন্য তথ্য থেকে দেখা যায় ম্যাপটা আঁকা হয়েছিল ১৫৩১ সালে। যিনি ম্যাপটা এঁকেছিলেন তার নাম পিরি রেইস। ইতিহাস থেকে জানা যায় অ্যাডমিরাল পিরি রেইস (Piri Reis) ছিলেন টার্কিশ অটোমান সাম্রাজ্যের সময়কার একজন কার্টোগ্রাফার। এটা নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে, কিন্তু দেখা গেছে এই ম্যাপে পিরি রেইস এন্টার্কটিকা অঞ্চল এঁকেছেন। ভৌতিক ব্যাপার হল এই যে তার সময়ে এন্টার্কটিকার খবর কারও জানার কথা না। এন্টার্কটিকা আবিষ্কৃত হয় বহু বছর পরে ১৮২০ সালে। এত আগে কিভাবে পিরি রেইস এন্টার্কটিকা এঁকেছিলেন সেটা একটা রহস্য। পিরি তার ম্যাপে সাউথ আমেরিকান কোস্টলাইন এঁকেছিলেন। কোস্টলাইনের লেজের দিকটা প্রায় নিঁখুত ভাবে আঁকা। শুধু তা-ই না, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে নিচের দিকটা বাঁকানো। এই বাঁকানো ব্যাপারটা একমাত্র মহাকাশ থেকেই দেখা সম্ভব পৃথিবীর গোলাকৃতির কারণে। পিরি রেইসের পক্ষে আর যা-ই হোক, মহাকাশে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই ম্যাপ ইতিহাসবিদদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং এর সুরাহা এখনও হয় নি।
আরও পড়ুন
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ১
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ২
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৪
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৫
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৬
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৭
আমার পাশের মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর চেষ্টা করেছিলাম কিছুক্ষণ। তার নাম আইলিন। বাবা টার্কিশ, মা শ্রীলঙ্কান। থাকে ইস্তাম্বুলে। মা আর এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সে ঢাকায় এসেছিল কোনো কারণে। এখন ফেরত যাচ্ছে। আমাদের পেছনের সিটে তার মা তার ভাইকে নিয়ে বসেছে। ওকে উৎসাহ নিয়ে পিরি রেইসের ম্যাপটা দেখালাম। সে কিছু জানে বলে মনে হল না। ইতিহাস নিয়ে মনে হচ্ছে তার খুব একটা আগ্রহ নেই।
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের জাস্ট অ্যানাদার টিনএজড্ বাচ্চার মতোই সে এখন “হোয়াটএভার” মুডে আছে।
কিছুক্ষণ পর খাবার সার্ভ শুরু হল। পরপর কয়েকবার খাবার এল। টার্কিশ খাবার এর আগে খেয়েছি। তবে এদের খাবার অনেক বেশি ভাল লাগল। প্রতিবারই বেশ কয়েকটা করে আইটেম এসেছে। একবার কয়েক রকম চিজের ছোট টুকরো, সঙ্গে অলিভ দেওয়া হল। আমি চিজ লাভার। যেকোনো কিছুর সঙ্গে দেখলাম চাইলেই বানরোল দিচ্ছে। বানগুলো চমৎকার। এদের সুগারলেস অরেঞ্জ জুসটাও বেশ ভাল খেতে। টার্কিশ ডিলাইট খাওয়া হল। জিনিষটা আর কিছুই না, মিষ্টি সফট্ লজেন্সের মত একটা বস্তু। খুবই এনজয় করলাম খাবার। খাওয়া, ঘুম, আবার খাওয়া, বাথরুমে যাওয়া এভাবেই চলতে থাকল। প্লেনের ক্যাপ্টেন কিছু বললে প্রথমে টার্কিশ ভাষায় বলে, তারপর বলে ইংরেজিতে। তুর্কি ভাষায় এরা যে পৃথিবীকে ‘দুনিয়া’ বলে জানতাম না। ক্যাপ্টেন তুর্কিতে যা কিছু বলছিল তার অনেকগুলো শব্দ চেনা চেনা ঠেকছিল। সাঁইয়োজান বলে একটা শব্দ দিয়ে সে কথা শুরু করে। মনে হল এটার বাংলা সজন বা ভদ্রমহোদয়/মহোদয়া হবে সম্ভবত। আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে ভেবে যখন কিছুটা অস্থির হচ্ছি, সেরকম সময়ে ক্যাপ্টেনের ঘোষণা এল যে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি।
ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে মনে হল কোনো কফি শপে ঢুকে পড়েছি। যেদিকেই যাই সেদিকেই কফির সুঘ্রাণ। আমার অবশ্য তখন কফি খাবার মতো অবস্থা নেই। প্লেন ল্যান্ড করেছে ডিলে করে। দুই ঘণ্টা যাত্রাবিরতি পাবো জানতাম, সেটা আর পাচ্ছি না। আমেরিকান প্লেনের বোর্ডিং শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। প্লেনে ওঠার আগে বহ্নিকে জানানো দরকার যে আমি টার্কিতে পৌঁছেছি। আমার মোবাইলে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং করা নেই। কথা বলতে হলে ইন্টারনেট ইউজ করতে হবে। এদিকে মোবাইলে ওয়াইফাই লিস্টে কোনো ফ্রি ওয়াইফাই-ও দেখাচ্ছে না। কিভাবে ইন্টারনেট কানেক্ট করব খুঁজতে গিয়ে দেখি এক ক্যাফের গায়ে লেখা ওয়াইফাই এভেইলেবল। দৌড়ে ভিতরে গেলাম। পাসওয়ার্ড চাইতে দেখি দোকানি হাসে। বলে, পাসওয়ার্ড ইজ ফর কাস্টোমার্স ওনলি। কি আর করা। একটা এসপ্রেসো অর্ডার দিলাম। সে জিজ্ঞেস করল, সিঙ্গেল অর ডাবল শট? কফির সিঙ্গেল আর ডাবল শটের যে কী মানে আমি জানি না। কিছু না বুঝেই বললাম ডাবল শট প্লিজ। সে একটা অত্যন্ত ছোট কাপের মধ্যে আলকাতরার মত ঘন কিছু একটা ঢেলে আমার হাতে দিল।
সঙ্গে টুক করে একটা কাগজে পাসওয়ার্ড লিখে দিল। এখন ওয়াইফাই তো কানেক্ট হলো। কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে কল যায় না। টেক্সট ম্যাসেজ যাচ্ছে শুধু। কি আর করা, কথা বলতে আর পারলাম না। শুধু ম্যাসেজে জানালাম যে আমি ঠিক আছি। বহ্নি বলল সাবধানে যেতে। হঠাৎ ডিসপ্লেতে দেখলাম বোস্টন যাবার প্লেনের বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে, আমাকে যেতে হবে গেট নাম্বার ৫০৩-এ। আলকাতরার মতো ঘন কফিটা আর শেষ করা হলো না। তবে সেই কফির সুবাস এতই চমৎকার ছিল যে এর পরে যতবার টার্কি হয়ে ইউএসএ গেছি, সেটা খেয়েছি। এখন আরেক ফ্যাসাদ। দেখি ৫০৩ নাম্বার গেট খুঁজে পাচ্ছি না। এ কী যন্ত্রণায় পড়া গেল! টার্কিশ ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই অত্যন্ত সুদর্শন হয়। এয়ারপোর্টের প্রায় প্রতিটা দোকানে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পরে তাদের দোকানে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। জলপরীর মত সুন্দর এক কফিওয়ালিকে জিজ্ঞেস করলাম গেট ৫০৩ কোথায় জানো? আমার প্রশ্ন শুনে অত্যন্ত খুশি হয়েছে এরকম গলায় সে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, পরীস্তানের ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষায় সে কথা বলতে পারে না। পাশের কফিশপের ছেলেটা আমাকে বলল দোতলায় যেতে। দোতলায় গিয়ে গেট ৫০১ থেকে ৫০৪ পর্যন্ত একটা সাইন ডিরেকশন পেলাম। কিছুদূর পর পর সাইন। দৌড়াতে দৌড়াতে সাইন ফলো করছি। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিচতলায়, কফিশপের ছেলেটা আমাকে যেখান থেকে দোতলায় যেতে বলেছিল ঠিক সেই জায়গাটায়। ওর দোকানের ঠিক সামনেই গেট নাম্বার ৫০৩। কেন সে আমাকে দোতলায় যেতে বলেছিল সেই রহস্য আজও বুঝিনি। আর সম্ভবত মাথা কাজ করছিল না দেখে গেটটাও আমার চোখে পড়েনি।
ইস্তাম্বুল থেকে বোস্টনে আসার পথে আমার এবারের সহযাত্রীটাও দেখলাম টিনএজড্ একটা ছেলে। পনেরো ষোল বছরের বালক। দুই এক কথায় জানলাম সে অ্যামহার্স্টের কোন ইন্সটিটিউট থেকে ইএসএল (English as a Second Language) করতে যাচ্ছে। চারমাসের থাকা খাওয়া আর কোর্স ফিসহ এই ছেলেকে দিতে হবে দশ হাজার ডলার। বাবার কত টাকা থাকলে এভাবে ছেলেকে ইউএসএ-তে ইংলিশ শিখতে পাঠায় সেটাই ভাবছিলাম মনে মনে। ভাবনায় আচমকা ছেদ পড়ল। পাশের রো থেকে একজন আমাকে হাই দিয়েছে। একুশ বাইশ বছর বয়সের একটা ছেলে। আমিও হাই দিলাম। এর পরের প্রশ্ন, ডু ইউ স্পিক ইংলিশ? টার্কিশ অ্যকসেন্টে প্রশ্নটা করল সে। আমি ইংরেজি জানি কি না এটা তার কেন জানা দরকার বুঝলাম না। হয়ত কোন প্রয়োজন আছে। যাই হোক, মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। এর পরের দশ ঘণ্টা কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু আমার গাধা ব্রেইন সেটা ধরতে পারেনি। বুঝলে হ্যাঁ বলতাম না। ছেলের পরের প্রশ্ন, তুমি কি ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রিতে থাক? বললাম না, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সে বলে, কিন্তু তুমি তো ইংলিশ বলতে পারো বলে মনে হচ্ছে। বললাম, আমাদের দেশের সবাই কাজ চালানোর মত ইংলিশ পারে। আমার উত্তর শুনে ছেলেটার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মত জ্বলে উঠল।
কাহিনী শুরু হল তারপর। জানলাম তার নাম ওমার। ওমার বাসারান। বাংলাদেশ সম্পর্কে সে খুব বেশি কিছু জানে না। তবে এর রাজধানী যে ঢাকা সেটা সে জানে। বাংলাদেশের পাশে কী কী দেশ আছে সেটা সে জানতে চাইল। বাংলাদেশ যে ইন্ডিয়ার পাশে এটা শুনে তাকে বেশ আপ্লুত মনে হল। বলল, আই লাভ ইন্ডিয়ান কালচার। বললাম ভেরি গুড। সে বলল, আই লাভ ইন্ডিয়ান ফিল্মস তু। ইউ নো আমির খান? আই লাভ হিম। এবারে প্লেনে খুব বেশি যাত্রী নেই। কোনো বাচ্চাও আশপাশে দেখলাম না। গেট খুঁজে না পেয়ে প্লেন মিস করব কি না এই নিয়ে টেনশনে ছিলাম। সেই টেনশন রিলিজ হয়ে এখন টায়ার্ডনেসে পরিণত হয়েছে। ঘুম পাচ্ছিল বেশ। কিন্তু ওমারের কথা আর থামছে না। হিন্দি সিনেমা থেকে এরপর সে দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে গেল। এবার সে পড়ল ইয়োগা নিয়ে। ইয়োগা কিভাবে করে। করলে কোনো উপকার পাওয়া যায় কি না ইত্যাদি নানান রকম প্রশ্ন। ঢাকায় কিছুদিন ইয়োগা চর্চা করেছিলাম। যা জানি বললাম। শুধু ইয়োগা না, তার ইন্ডিয়ান ধ্যান শেখারও খুব শখ আছে জানলাম। আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি, কথা যা বলার সে-ই বলছে।
সে আমাকে তার প্ল্যান বলল। তার ইচ্ছা সে ইয়োগা আর ধ্যান শেখার জন্য ইন্ডিয়া যাবে। আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি মনে কর এক বছর ইন্ডিয়া থাকা যথেষ্ট হবে ধ্যান শেখার জন্য? আমি বললাম, তুমি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারো? সে বলে, অবশ্যই! আমি বললাম, তাহলে এক কাজ করো। ইন্ডিয়া গিয়ে কয়েক বছরের জন্য হিমালয়ে চলে যাও। হিমালয় গিয়ে একটা গুহা খুঁজে বসে পড়। গায়ের জামা কাপড় খুলে অন্য কাউকে দিয়ে দিও। ধ্যানমগ্ন হতে গেলে জামাকাপড় একটা বাহুল্য। ধ্যানে বিঘ্ন ঘটতে পারে। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, মানে পুরোপুরি জামাকাপড় ছাড়া থাকতে বলছ? ইউ আর কিডিং রাইট? বললাম, নো, আই অ্যাম নট কিডিং। আশেপাশের যাত্রীরা আমাদের দুইজনের এই উদ্ভট কনভারসেশন শুনছে বলে মনে হল। তারা যে কী ভাবছে কে জানে। ওমার মনে হল আমার ধ্যানের সাজেশন শুনে কিছুটা মুষড়ে পড়েছে। তার মুখ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়েছে দেখে চোখটা একটু বুজলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি পাশের সিট থেকে এক জোড়া চোখ ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কেউ না, ওমার। সে আমার পাশের সিটের ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে নিজের সিটে। ছেলেটা উইন্ডো সাইডে ছিল আর আমি আইল সাইডে। ঘুমন্ত আমাকে ডিঙ্গিয়ে এই দুই বান্দা কোন যাদুতে যে সিট পাল্টালো আমি জানি না। আমাকে জাগতে দেখেই ওমার আবার শুরু করল বিরামহীন কনভারসেশন। বলল, ইউ নো ম্যান, আমি মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য ইউএসএ যাচ্ছি। আমার একটু ইংলিশ প্র্যাকটিস করা দরকার। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছিল, আর তুমি ঘুমিয়ে পড়লে? শেম! আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আসলেই শেম। বল এবার কী জানতে চাও। সে প্লেনের টেম্পারেচার নিয়ে কথা বলা শুরু করল। সেখান থেকে চলে গেল প্লেন ক্র্যাশে। সেখানে থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। আমি ঝিম মেরে শুনছি আর মনে মনে ভাবছি মাবুদে এলাহি, এ কি বিপদে পড়লাম!
বোস্টন লোগান এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ওমার বিদায় হয়েছে। কিন্তু সে আমাকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে। প্লেনে দশটা বাচ্চা দশদিক থেকে কাঁদলেও মনে হয় না এতটা টায়ার্ড হতাম। ইমিগ্রেশনে তেমন কোনো ঝামেলা হলো না। লাগেজ পেতেও একেবারেই সময় লাগল না। সুখের বিষয় হচ্ছে এখানে নেমেই এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই কানেক্ট করতে পেরেছি। বাসাতেও কথা বলতে পেরেছি। আমি এয়ারপোর্টের ভেতরটা দেখছিলাম। খুব বেশি বড় না এই টার্মিনালটা। এই সেই লোগান এয়ারপোর্ট যেখান থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে দু’টো প্লেন আকাশে উড়েছিল। কেউ জানত না তারা আছড়ে পড়বে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। এরপরে পৃথিবী যে আর একইরকম থাকবে না সেটাও তখনো কেউ জানত না।
লাগেজ নিয়ে গেটের বাইরে গিয়েই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে পড়লাম। হাল্কা তুষারপাত হচ্ছে। বাইরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আতাউর আর রাজীব, আমার দুই কলিগ। আমাকে রিসিভ করতে এসেছে তারা। রাজীব বলল, ওয়েলকাম টু বোস্টন জাকির ভাই। ওদেরকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার তুষারপাত দেখেও খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। শুধু আমি না, আমার স্যুটকেসও সম্ভবত এই দৃশ্য দেখে আনন্দিতবোধ করছিল। আনন্দে সে টাশ জাতীয় একটা শব্দ করল। দেখি স্যুটকেসের ট্রলির হাতলটা ভেঙে আমার হাতে চলে এসেছে। পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের হাতলটা ঠাণ্ডা আর তুষারপাতের ডাবল উত্তেজনাটা নিতে পারে নি। কোনোরকমে ধরাধরি করে সেটাকে গাড়ির পেছনে উঠানো হল। আমাকে যেতে হবে ওয়ালথামের অ্যাডামস্ স্ট্রিটে। সেখানে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ঘড়িতে বাজে লোকাল টাইম সাড়ে ছয়টা। সূর্য ডুবতে বসেছে। আলো আঁধারির বোস্টন সিটি দেখতে দেখতে আমি চললাম আমার গন্তব্যের দিকে।
(চলবে)
সারাবাংলা/এসএসএস