খালেদা জিয়াকে নিয়ে মহা টেনশনে বিএনপি
১৬ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩৯ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২১ ০৯:১৭
ঢাকা: টানা দুই বছর আইনি লড়াই চালিয়েও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারছিল না বিএনপি। কিন্তু গত বছর ২৪ মার্চ হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান- খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ৬ মাসের জন্য সাময়িক মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’
সেই দিন তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। উনাকে কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে – সেটা ভালো করে জেনে তারপর প্রতিক্রিয়া জানাব।’
সময়ের ব্যবধানে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রক্রিয়া, শর্ত, উদ্দেশ্য— সব কিছু সম্পর্কে জেনেছেন বিএনপি নেতারা। বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ১৭ তম দিনে সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার ‘সাময়িক’ মুক্তির পেছনে সব চেয়ে বড় কারণটি ছিল তাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা। হাসপাতালে না রেখে ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে বাসায় পাঠানো হয়েছিল করোনার ঝুঁকি কমাতে— এ বিষয়টি বিএনপির কাছে পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: ‘ফিরোজা’র ৯ জন করোনায় আক্রান্ত, খালেদার জন্য কেবিন প্রস্তুত
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মুক্তির ১ বছর ১৫ দিনের মাথায় গত ১০ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তার বাসার অন্যরাও কোভিড-১৯ পজিটিভ।
অন্য যে কোনো ইস্যুতে সমর্থন বা সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার বাসা বা অফিসের সামনে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হলেও করোনা ইস্যুতে সেই সুযোগ নেই। সে কারণে বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করতে গেলে রাস্তার দুই পাশে দলের নেতাকর্মী সমর্থকেরা ভিড় করতে পারেনি। বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে পাশে দাঁড়ালে খালেদা জিয়া তাকে মৃদু ভৎর্সনা করেন।
দলীয় সূত্রমতে, শুধু ওই একজন ভাইস চেয়ারম্যান নন, দলের প্রত্যেকটা নেতাকর্মী সমর্থক চান- খালেদা জিয়ার পাশে থাকতে, তার প্রতি সমর্থন ও সমবেদনা জ্ঞাপন করতে। কিন্তু নিজের এবং খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সবাই মোটা-মুটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া-প্রার্থনা-শুভকামনা অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকেরা।
আরও পড়ুন: ‘খালেদা জিয়া যথেষ্ট ভালো আছেন’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক তো বটেই এ দেশের সাধারণ মানুষ, দলমত নির্বিশেষে সবাই বিএনপির চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। এ দেশে অসংখ্য মানুষ আছেন, মা-বোনেরা আছেন, যারা খালেদা জিয়ার জন্য নফল রোজা রাখেন, দোয়া করেন।’
জানা গেছে, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের দিক থেকেও খালেদা জিয়াকে নিয়ে মহা টেনশনে আছে বিএনপি। তার বয়স, শারীরিক অবস্থা— সব মিলিয়ে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ব্যাপারে চিন্তিত বিএনপি নেতারা। গত তিনবছর ধরে বদ্ধ জায়াগায় প্রায় একাকী জীবন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানাবিধ কারণেই তাকে নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হচ্ছে বিএনপি নেতাদের।
তারা বলছেন, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও তাকে সামনে রেখেই এগোচ্ছে বিএনপি। হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে সব কিছু এলো-মেলো হয়ে যেতে পারে। দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর করোনায় মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার আক্রান্তের খবর বিএনপিকে মহাটেনশনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এখন সব কিছু ফেলে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা এবং আশু করোনামুক্তির জন্য প্রার্থনায়রত রয়েছে বিএনপি।
অবশ্য এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা ‘ভালো’ খবরই দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি। সিটি স্ক্যান রিপোর্টও ভালো এসেছে। শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ম্যাডামের অবস্থা স্থিতিশীল আছে। সিটি স্ক্যানের ফাইনাল রিপোর্ট মিনিমাম ইভলমেন্টের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে আমরা রিপোর্টি পর্যালোচনা করেছি। রিপোর্ট পর্যালোচনার আগের ওষুধের সঙ্গে আরেকটি ওষুধ যোগ করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক টিমের প্রধান ডা. এফ এম সিদ্দিকী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) অবস্থা খুবই স্থিতিশীল। আজকে পর্যন্ত উনি যথেষ্ট ভালো আছেন। উনি স্পিরিটেড আছেন। আমরা আশা করছি, যদি এভাবে আরও এক সপ্তাহ পার হওয়া যায়, তাহলে আমরা বিপদমুক্ত হয়ে যাব।’
তিনি বলেন, ‘কোভিডে আনসারটেনিটি আছে। পৃথিবীর কেউ বলতে পারবে না যে, করোনা প্রথম সপ্তাহে কেমন থাকবে, সেকেন্ড উইকে কি বিহ্যাব করবে। উনি আজ সেকেন্ড উইকে প্রবেশ করছেন। আজ কিছুটা জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিয়েছে। আমরা সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি।’
শুধু খালেদা জিয়া নন, বিএনপির প্রেস উইংয়ের দেওয়া তথ্যমতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন আছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ডা: এ কে এম আজিজুল হক, ডা: ফরহাদ হালিম ডোনার, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন মিডিয়া কমিটির সদস্য সাংবাদিক আতিকুর রহমান রুমন, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল প্রমুখ। একদিন আগে করোনামুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং তার স্ত্রী।
এরইমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বিএনপির পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর জেনারেল (অব:) রুহুল আলম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হক, ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসন, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান, ওলামা দলের নেতা মওলানা কাসেমী, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহসভাপতি খন্দকার আহাদ আহমেদ, ঢাকা পল্লবী থানা বিএনপির সহসভাপতি মো: আনিসুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী টি এম গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি সভাপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য অ্যাডভোকেট কবির চৌধুরী, জাতীয় ট্যাক্সসেস বার সভাপতি অ্যাডভোকেট গফুর মজুমদার, শ্রমিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক মোল্লা, গাজীপুর শ্রীপুর পৌরসভা বিএনপি মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহীদ, আমেরিকার বোস্টন বিএনপি ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মিতোষ বড়ুয়া, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার, এ টি এম আলমগীর প্রমুখ।
এমন পরিস্থিতিতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে মহা টেনশনে পড়ে গেছে বিএনপি। দলীয় প্রধানের সম্ভব্য পরিণতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। হাতে গোনা দুয়েকজন ছাড়া শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রায় সবাই করোনা আক্রান্ত। প্রতিনি দিনের যে মৃত্যুর মিছিল, সেখানে কখন কার নামযুক্ত হয়, তা নিয়ে শঙ্কিত দলের হাইকমান্ড।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘টেনশন তো বটেই। যে দুরবস্থার মধ্যে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী, সেখানে আমরা কেউ নিরাপদ নই। আমাদের দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও আক্রান্ত হয়েছেন। তবে আশার বিষয় হলো— তিনি এখন পর্যন্ত স্ট্যাবল আছেন, সুস্থ আছেন। আশা করছি দ্রুত সেরে উঠবেন।’
সারাবাংলা/এজেড/একে