Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এ উৎসব জাতিসত্তার পরিচায়ক, বাঙালি টিকিয়ে রাখবেই’

রাজনীন ফারজানা, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২০:৪০ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩৩

ঢাকা: বাংলাদেশের বয়স ৫০ হলেও বাঙালি জাতিসত্তা হাজার বছরের পুরনো। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের সহজ-স্বাভাবিক জীবন। সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি নানা উৎসবে আর আয়োজনে। এদের মধ্যেই সবচেয়ে বড় আয়োজন পহেলা বৈশাখ। রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বহু আগে থেকেই এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব।

নববর্ষে খোলা হবে নতুন খাতা। দোকানে দোকানে, রাজার প্রাসাদে চলে মিষ্টি বিতরণ। বাংলা মায়ের সহজ মানুষগুলো ধোয়া কাপড় পরে যোগ দেন সেই উৎসবে। ছেলে-মেয়ের হাত ধরে যান গঞ্জের আড়ংয়ে। কিনে আনেন মাটির হাড়িকুড়ি-তৈজসপত্র, মাটির খেলনা, পুতুল, বাঁশি, ভেঁপু, বাঁশ আর কাঠের নানা ছোটবড় আসবাব থেকে শুরু করে সংসারের নানা জিনিস। বিরাট মেলা উপলক্ষেই জুটে যেত পুতুলনাচ, যাত্রার দল। কোথাও কোথাও আবার আয়োজন হতো ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা।

বিজ্ঞাপন

এভাবেই বাঙালি জীবনের হাতেগোনা কয়েকটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবের অন্যতম বড় উৎসবে পরিণত হয় পহেলা বৈশাখ। এরপর নানা ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও বাঙালি ভোলেনি তার গায়ে লেগে থাকা মাটির গন্ধ। তাই প্রতিবছর জাঁকজমকের সঙ্গে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়ে পহেলা বৈশাখ প্রবেশ করেছে আধুনিক জীবনে। সাতচল্লিশে ভারতভাগের পর বাংলা এই নববর্ষই সাংস্কৃতিক পরিচয় আর আন্দোলনের নতুন হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

দেশভাগের পর পাকিস্তানিদের শোষণ-অনাচারে বাঙালির বুকে তখন স্বাধীনতার আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। বাঙালিকে দমিয়ে রাখেতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তখন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। তখন ছায়ানটের শিল্পীরা পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হয়ে রবি ঠাকুরের গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেই রমনার বটমূল হয়ে ওঠে বর্ষবরণের সমার্থক অনুষঙ্গে। পাকিস্তানের অধীন ২৩ বছর ধরে যে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও প্রেরণা জুগিয়েছে এই পহেলা বৈশাখ।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা বর্ষবরণের এই উৎসব জাতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় যশোর আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা শুরু করেন মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট আরও ব্যাপকভাবে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করতে শুরু করে। অন্যায় আর অপশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে তুলে ধরতে তারা চিরায়ত বাংলার পুতুল, মোটিফ ইত্যাদি নিয়ে শুরু করেন এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। একসময় এই শোভযাত্রা রূপ নেয় জনমানুষের অংশগ্রহণে এক জাতীয় উৎসবে।

এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পহেলা বৈশাখ পরিণত হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচায়ক। আর সেই পরিচয় হয়ে ওঠার পথটাও সরল ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এই বর্ষবরণের আয়োজনকে। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর আঘাত হানতে এই উৎসবের ওপরই বারবার আঘাত হেনেছে শাসকগোষ্ঠী।

বিশিষ্ট লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির শ্বাশ্বত উৎসব। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব। সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন সবসময়ই ছিল। কিন্তু তারা কখনোই জিততে পারেনি। বাঙালি অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে, অনেক রক্ত ঝরিয়ে তবে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। তাই যে সাম্প্রদায়িক মহল পহেলা বৈশাখকে বিতর্কিত করতে চায়, তাদের সেই চেষ্টা সফল হবে না। সত্য আর সুন্দরের জয় সবসময়ই হয়।’

একই কথার সুর উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ডিন নিসার হোসেনের কথাতেও। তিনি বলেন, বরাবরই একটি গোষ্ঠী এই আয়োজনকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সরকার যেমন বাংলা সংস্কৃতিকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বারবার, তেমনি এখনো একটি শ্রেণি সেই চেষ্টা করছে। এরা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। এর মানে এই না যে বাংলাদেশের সব মানুষ সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি শক্তি পাকিস্তানের সমান্তরাল রাষ্ট্র গঠনের আশায় এসব প্রচারণা চালায়।

গতবছর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ থাকার কারণে দেশব্যাপী ‘সাধারণ ছুটি’ থাকায় বাতিল হয়ে যা পহেলা বৈশাখসহ সব অনুষ্ঠান। এ বছরও করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ফলে আবারও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ফলে এবারও আগের মতো বড় পরিসরে মঙ্গল শোভযাত্রা হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজুবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ স্মরণে রেখে সীমিত পরিসরে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পহেলা বৈশাখ মানেই যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা, তেমনি সকালের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক আয়োজন। গত বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে বন্ধ ছিল এই আয়োজন। এবার শুরুতে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান চালানোর পরিকল্পনা থাকলেও করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় বাদ দিতে হয়েছ সেই পরিকল্পনাও।

রমনার এই বটমূলেও বৈশাখ বরণের আয়োজনকে রক্তাক্ত হতে হয়েছে। রমনার বটমূলে বোমা হামলার দিন ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন ছায়ানটের সহসভাপতি বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল।১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার সময়ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনি। দু’বারই অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পহেলা বৈশাখ সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলার লক্ষ্য হলেও শাকিল বলছেন, তিনি আশাবাদী যে বাঙালি সংস্কৃতিকে এত সহজে দমিয়ে রাখা যাবে না।

খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, সেদিন রমনার বটমূলে বোমা হামলার পরপরই সেখানে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পরেরবার আর এরকম আয়োজন করা সম্ভব হবে কি না। সেদিন সব ছাত্র-অভিভাবক প্রবল প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, তারা আগামীবারও আসেবন এবং গান গাইবেন। এভাবে বাঙালি সবসময়ই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ওরা আগেও কিছু করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। বাঙালি পহেলা বৈশাখের উৎসবে মাতবেই।

বাঙালি জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর থেকে আস্থা ও বিশ্বাস হারাতে চান না লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হকও। তিনি বলেন, সবসময়ই আমরা প্রতিবাদে সরব থেকেছি। আমরা সেই পঞ্চাষ-ষাট বছর আগেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চিনেছি। আমরা জয় বাংলা বলেছি। আর এভাবেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখন এসে ‘আমরা সবাই বাঙালি’ স্লোগান দিচ্ছে। তারা বাঙালি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমরা সবসময়ই জানতাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা বাঙালি আর সেই চেতনাই ধারণ করি। একসময় এরশাদ আমলে যখন আলপনাকে হারাম বলা হয়, পরদিনই এয়ারপোর্ট রোড থেকে শুরু করে বিরাট এলাকার রাস্তায় আলপনা এঁকে ভরিয়ে ফেলা হয়। এভাবেই বাঙালি সবসময়ই তার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরেছে, এখনো ধরছে, ভবিষ্যতেও এই ধারা বজায় রাখবে।

চারুকলা ইনস্টিটিউটের নিসার হোসেন বলেন, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির কোনো বিরোধ নেই। আমাদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনকেও তো দেখি ধর্ম পালন করতে। তারা তো কখনই এমন ছিলেন না। এখন রাজনৈতিক কারণে একটি সাম্প্রদায়িক মহল নানা কথা প্রচার করলেও এগুলো টিকবে না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আশাবাদও দেখছেন চারুকলার এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি আশার আলোই দেখতে পাচ্ছি। সাম্প্রদায়িক শক্তি একসময় আধুনিক যেসব জীবনব্যবস্থার বিরুদ্ধেই ফতোয়া দিত, আজ তারা সেসবে অভ্যস্ত হয়েছে। আজ যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো নিরীহ বিষয়ে ধর্ম জড়িয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, আমার আশা— তারাই একসময় এটি সাদরে গ্রহণ করবে।’

একই কথার সুর ফুটে ওঠে আনোয়ারা সৈয়দ হকের কথাতেও। তিনি বলেন, দেখুন সংস্কৃতি আমাদের জন্য চিরকালীন। এ দেশে যখন ইসলাম ধর্ম এসেছে, আমরা অনেকেই সেটিকে গ্রহণ করেছি। কিন্তু ধর্ম পালন করতে গিয়ে আমরা সংস্কৃতি যা আমাদের জাতীয় পরচয়ের যে বাহন, তাকে ছুড়ে ফেলিনি। এবার রোজা আর পহেলা বৈশাখ একই দিনে চলে আসায় আমরা রোজার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীদের তো আর বৈশাখের উৎসব পালনে বাধা নেই। এমনকি রোজার মধ্যেও কেউ বৈশাখের দিনটি পালন করতে চাইলে সেটিও তিনি করতেই পারেন। আমি মনে করি, পহেলা বৈশাখের মতো এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব সবসময়ই থাকবে। আর সময় অনুকূলে থাকলে বিপুল পরিসরে সে উৎসব উদযাপনও করবে মানুষ।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

জাতিসত্তার উৎসব পয়লা নববর্ষ বাঙালির উৎসব বাংলা নববর্ষ

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর