Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্যারেড গ্রাউন্ডে ফিরে এলেন ‘চিরন্তন মুজিব’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ মার্চ ২০২১ ২৩:৫৭ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২১ ০০:১৬

ঢাকা: যেন ফিরে এলেন সেই মুজিব। তিনি জাতির জনক। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার হাত ধরে বাংলাদেশ পেয়েছিল স্বাধীনতার স্বাদ। পঁচাত্তরে ঘাতকের নির্মম বুলেট যার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, সেই মুজিবই যেন ফিরে এলেন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। হ্যাঁ, তিনি আজ ফিরে এসেছিলেন ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানমালায়— গানে গানে, নৃত্যে লয়ে, ছন্দ-তালে, কবিতার ছন্দে। আরও একবার বিশ্ববাসী দেখল বাঙালি জাতির ইতিহাসের অমর সর্বাধিনায়ককে, যার ক্ষয় নেই, যিনি শ্বাশত-অনিঃশেষ।

বিজ্ঞাপন

১০১ বছর আগে যে মুজিব জন্ম নিয়েছিলেন গোলাপগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, সেই মুজিবই তার ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে বুধবার (১৭ মার্চ) বিকেলে ফিরে এলেন রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোর আর শিল্পীর কণ্ঠে, নৃত্যশিল্পীর পায়ের নাচনে, অভিনয়শিল্পীদের প্রতিটি বাচনভঙ্গিতে যেন ফুটে উঠলেন। দেশি-বিদেশি অতিথিদের উপস্থিতিতে সে অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্তেই ধ্বনিত হচ্ছিল একটিই নাম— মুজিব।

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত বছর থমকে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন। জনসমাগম এড়িয়ে সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল মাধ্যমে গত একবছর ধরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল। এবারে বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীর দিনটিতে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হলো প্যারেড গ্রাউন্ডে। ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের থিম ছিল ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’। আর করোনাকালে এই প্রথম মুক্ত প্রাণে সীমিত জনসমাগমে মঞ্চের বিভিন্ন উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুর ‘মহাকাল’ মন ভরে উপভোগ করলেন তার দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা।

দুইটি পর্বে বিভাজিত ছিল ‘মুজিব চিরন্তন’-এর ১০ দিনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী দিনটি। প্রথম পর্বে আলোচনার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে ছিল বর্ণাঢ্য জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। বিকেল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয় শত শিশুর কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এরপর তারা সমবেত কণ্ঠে আরও দুইটি গান পরিবেশন করে। এরপর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মুজিব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী আয়োজন উপকমিটির আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথিসহ সম্মানিত আমন্ত্রিত অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার আহ্বান করেন। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’ থিমের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত অডিও-ভিজ্যুয়ালে ফুটে উঠে জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায়। মুজিববর্ষের ‘থিম সং’য়ের মিউজিক ভিডিও পরিবেশনার পর বিমানবাহিনীর ফ্লাই পাস্টের রেকর্ড করা ভিডিও প্রচার হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত সম্ভাষণ দেন মুজিব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এরপরই সম্মানিত অতিথি চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা’র ধারণ করা ভিডিওবার্তা প্রদর্শন করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক মার্ক টালির ধারণকৃত বার্তাও প্রদর্শন হয়।

এর আগে, চীনের রাষ্ট্রদূত দেশটির পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে দেন, তার একটি ভিডিও প্রচার করা হয় এই অনুষ্ঠানে।

সম্মানিত অতিথি মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্’র বক্তব্যের পর বক্তব্য দেন প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর সম্মানিত অতিথিদের ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা-স্মারক উপহার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয় আলোচনা পর্ব।

দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়। এপার-ওপার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শিল্পী-কলাকৌশলীরা মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপহার দেন। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানের সুরে যন্ত্র-ছন্দ তালে মুজিব প্রাণকে প্রাণবন্ত সজীবতায় ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। এরপর পরিবেশন করা হয় লালনগীতি ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি, প্রধান অতিথি, সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে মুজিব চিরন্তন শ্রদ্ধা স্মারক প্রদান করা হয়। এই শ্রদ্ধা স্মারকে ফুটিয়ে তোলা হয় বাঙালির মুক্তি এবং স্বাধীনতার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক তর্জনী। জাতির পিতার পরিবারের সদস্য ও পৃথিবীর সব শান্তিকামী মানুষের প্রতীক হিসেবে এই স্মারকে আছে ৯টি উড়ন্ত পায়রা। এই স্মারকের মূল বৈশিষ্ট্য হলো— এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে টুঙ্গিপাড়ার মাটি। স্মারকটি নির্মাণ করেছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। অতিথিদের হাতে স্মারক তুলে দেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান নূর দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করেন, ‘সেদিন তিনি ফিরে আসলেন…’। তার কবিতার ধ্বনি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি যুদ্ধবিধস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর জাতির পিতার দেওয়া ভাষণটি বাজানো হয়। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের ধারণ করা বক্তব্যও শোনানো হয়। মুজিববর্ষ উদযাপনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন তিনি। এর প্রেক্ষাপট ও পটভূমি তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্রও প্রদর্শন করা হয়।

এরপর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করা হয় ‘জয় মুজিবের জয়, জয় বাংলার জয়’ গান। বাজানো হয় জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’। মনে হয় যেন মুজিব ফিরে এসেছেন। মঞ্চে ছোট্ট শিশুর সাজ ছিল বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনা হাসু’র ছোট বেলার সাজে।

অনুষ্ঠানে ফুটিয়ে তোলা হয় ১৯২০ সাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ ক্লান্ত বিধস্ত পৃথিবী, অশান্তি হানাহানি গ্রাস করে নেওয়া পৃথিবীর প্রতিরূপকে। সেই অস্থির সময়ে এক নবজাতকের জন্মক্ষণের কান্নার ধ্বনি জানিয়ে দেয়, মুজিব জন্ম নিয়েছে। সেই ক্ষণটি নৃত্যগীতে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। আর এর ফাঁকে ফাঁকে আবহসংগীত হিসেবে বেজে ওঠে— ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হোক জয়…’।

ভিডিওতে প্রদর্শন করা হয় ভারতবর্ষে তুলনামূলক চিত্র। ভারত ভাগ থেকে বিভিন্ন ইতিহাসের সচিত্র বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলা হয় পরাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। সেই প্রেক্ষাপটেই যে সময়ের বাঁকে শৈশবের ‘খোকা’ থেকে তারুণ্যে ‘মিয়া ভাই’, আর কালে কালে ‘শেখ মুজিব ভাই’ থেকে বাঙালির মহানায়ক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা। আজীবন যে আন্দোলন-সংগ্রাম তিনি করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য, তার বিভিন্ন অধ্যায় একে একে ফুটে ওঠে ভিডিওতে।

মনোমুগ্ধকর অর্কেস্ট্রা মিউজিকের সঙ্গে গান, বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী চিঠি উৎসর্গের পাশাপাশি ‘মুজিব শতবর্ষের কার্যক্রম ফিরে দেখা’ শীর্ষক ভিডিও দেখানো হয় অনুষ্ঠানে। সংগীত পরিবেশন করেন সাদি মোহাম্মদ, রফিকুল আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শিমূল ইউসূফসহ সহশিল্পীরা। বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বন্ধুরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপস্থাপন করেন ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের নেতৃত্বে একটি দল। বর্ণিল আতশবাজি ও লেজার শোয়ের মাধ্যমে রাত ৮টার পরে শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন।

মুজিব শতবর্ষ জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, মুজিবশতবার্ষিকী কেন? বাঙালি জাতি এক হতভাগ্য জাতি। শত শত বছর বিদেশিদের দ্বারা বহিরাগতদের দ্বারা, বিদেশি ভাষার দ্বারা, শাসিত-শোষিত লাঞ্ছিত, অবমানিত-পদানত থেকেছে। ছোটখাটো বিদ্রোহ হয়েছে। তা সফল হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন পাকিস্তান হলো, দেখা গেল— একটা ‘মহাফাঁকিস্থান’। সেই পাকিস্তানের সঙ্গে যে ২৪ বছর আমাদের কেটেছে, তার তিক্ত অভিজ্ঞতা সহজে ভোলবার নয়। এ অবস্থা থেকে যেই বাংলা চিরকাল বিদেশিদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে, এমনকি পুর্তুগিজ জলদস্যু, মারাঠারা পর্যন্ত বাংলাদেশকে লুণ্ঠন করেছে, এরকম সব শক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, এই শত শত বছরের গোলামির জিঞ্জির থেকে বাঙালিকে মুক্ত করার জন্য একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটল। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি তার আজীবন প্রয়াসে বাংলাদেশকে বিদেশিদের শোষণ এবং শাসনমুক্ত করলেন। বিনিময়ে তাকে সপরিবারে জীবন দিতে হলো। কিন্তু তিনি অমর হয়ে গেলেন। মানুষ একবারই মরে, কিন্তু মানুষের কর্ম দ্বারা স্থির হয়— তিনি অমর কি না। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি আমাদের এক স্বাধীন জাতি উপহার দিয়ে গেছেন এবং সেই স্বাধীনতা আমরা এখন উপভোগ করছি। বঙ্গবন্ধুর চরম অবদান— তিনি একটি পরাধীন জাতিকে গোলামির অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। সেই জন্য আমরা তার কাছে চিরঋণী। বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।

সারাবাংলা/এনআর/টিআর

জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড টপ নিউজ বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকী মুজিব চিরন্তন

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর