চমেক ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে মারামারি, কক্ষ ভাংচুর
২ মার্চ ২০২১ ১৮:২৪ | আপডেট: ২ মার্চ ২০২১ ২২:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও মারামারি হয়েছে। এসময় অন্তত ১২টি কক্ষ ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
মঙ্গলবার (২ মার্চ) দুপুরে নগরীর চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী রোডে প্রধান ছাত্রাবাসে সংঘাতে জড়ায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরা। সংঘাতের জন্য বিবাদমান ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা একে অপরকে দায়ী করেছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দীর্ঘদিন ধরে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী পরিচয় দেওয়া ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ছিল। কিন্তু গত তিনবছর ধরে তাদের একক আধিপত্যের বিপরীতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী পরিচয়ে ছাত্রলীগের আরেকটি অংশ ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়েছে। এর আগেও উভয়পক্ষ কয়েকদফা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
আধিপত্যের জেরে মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় লাঠিসোঠা, হকিস্টিকসহ দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা করে। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং কক্ষে-কক্ষে ভাংচুর হয়। পরে পুলিশকে দুইপক্ষের নেতাকর্মীদের দুইদিকে সরিয়ে দিতে দেখা গেছে।
ঘটনাস্থলে ছাত্রলীগের উভয়পক্ষে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধান ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় ‘এ’ ব্লকে আধিপত্য আছে নওফেলের অনুসারীদের। আর বি-ব্লক নিয়ন্ত্রণে আছে নাছির অনুসারীদের। তবে বেশি কক্ষ দখলে আছে নাছিরের অনুসারীদের।
মঙ্গলবার দুপুরে নাছিরের অনুসারীরা দ্বিতীয় তলার কয়েকটি কক্ষ থেকে কয়েকজন ছাত্রকে বের করে দেয় বলে অভিযোগ নওফেলের অনুসারীদের। এর জেরে মারামারি শুরু হয় বলে দাবি তাদের। তবে নাছির অনুসারীরা অভিযোগ করেছেন, পরিকল্পিতভাবে হামলা করে ছাত্রাবাস থেকে তাদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নওফেলের অনুসারীরা। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের ৫-৬ জন করে নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি তাদের।
নওফেলের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা চমেকের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অভিজিৎ দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাদের (নাছির অনুসারী) রুমে তারা ২-১ জন করে থাকে। আর আমাদের রুমে আমরা ৫-৬ জন গাদাগাদি করে থাকি। সেই রুমগুলো থেকেও আমাদের বের করে দেওয়ার জন্য তারা হামলা করেছে। রুমে রুমে ঢুকে আমাদের বিছানা-বালিশ, টেবিল-চেয়ার তছনছ করেছে, কক্ষ ভাংচুর করেছে। এমনকি আমাদের বইখাতা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। আমাদের পরীক্ষা চলছে। আমরা ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের ওপর তারা অতর্কিত হামলা করে।’
নওফেলের অনুসারী তৃতীয় বর্ষের আরেক ছাত্র শামীম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা অনেকেই ক্যাম্পাসে ছিলেন। কেউ কেউ নিজের রুমে ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রথমে নাছির গ্রুপের ছেলেরা এসে আমাদের কয়েকজন ছেলেকে রুম থেকে বের করে দেয়। এরপর আমরা প্রতিবাদ করলে তারা হামলা করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা মিলে তারা ১২-১৩টি রুম ভাংচুর করেছে।’
নাছিরের অনুসারী ও চমেক ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক পরিচয় দেওয়া অনির্বাণ দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘হোস্টেলের প্রায় সব কক্ষেই আমরা ছিলাম। তারা ছিল না। হঠাৎ করে এসে তারা হোস্টেলে উঠে রুম দখল শুরু করে। নিজেদের শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল সাহেবের অনুসারী পরিচয় দিয়ে তারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। আমার কক্ষে ঢুকে ভাংচুর করেছে তারা। আমাদের ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে একটা আনন্দ মিছিলের কর্মসূচি ছিল। আমরা সেখানে ব্যস্ত ছিলাম। এই ফাঁকে তারা আমাদের রুমে ভাংচুর শুরু করে। তখন খবর পেয়ে আমরা আসি। পুলিশের সামনে তারা এ কাজ করেছে। পুলিশ কিন্তু বাধা দেয়নি।’
নাছিরের অনুসারী চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসেফ বিন ত্বাকী রিফাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘চমেক ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে আ জ ম নাছির উদ্দীন ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন হুট করে যারা কোনোদিন ছাত্রলীগ করেনি, ছাত্রলীগের সভাপতির নাম বলতে পারবে না, ছাত্রশিবির করে আসা লোকজন নিজেদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার নওফেল সাহেব বলছেন, ক্যাম্পাসে উনার কোনো গ্রুপ নেই। তাহলে আমাদের প্রশ্ন- ক্যাম্পাসে যারা উনার নামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করছেন তারা কারা?’
প্রধান ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রাবাসের সামনে আঙ্গিনায় হকিস্টিক, ভাঙ্গা অবস্থায় ২টি চেয়ার, বালিশ-বিছানাপত্র, ছেঁড়া অবস্থায় বইপত্র-ক্রেস্ট এবং অনির্বাণ দে’র ভিজিটিং কার্ড পড়ে আছে। দ্বিতীয় তলায় সাধারণ পাঠকক্ষের জানালার কাচ, চেয়ার-বইয়ের তাক ভাংচুর অবস্থায় দেখা গেছে। পাঠকক্ষের ভেতরে ইটের টুকরা ও লাঠি জমা অবস্থায়ও পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কক্ষে খাট, বইয়ের তাক, টেবিল-চেয়ারসহ আসবাবপত্র এবং বিছানাপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখা গেছে। কয়েকটি কক্ষের দরজা-জানালাও ভাংচুর হয়েছে।
ঘটনাস্থলে যাওয়া নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে ছাত্রলীগের দুইটা গ্রুপ আছে। হোস্টেলে অবস্থান নিয়ে আগেও তারা কয়েকবার মারামারি করেছে। তখন আমরা কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে মিলে তাদের হোস্টেলের দুই দিকে ভাগ করে থাকার ব্যবস্থা করে দিই। এখানে বামপাশে (এ-ব্লক) থাকে একপক্ষ। আর ডানপাশে (বি-ব্লক) আরেক পক্ষ থাকে। যতটুকু জানতে পেরেছি, বামপাশের কিছু ছেলে যাদের আগামীকাল পরীক্ষা আছে, তারা সম্ভবত এসে ডানদিকের কয়েকটি কক্ষে উঠেছিল। তাদের তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সমস্যা হয়। আমরা ঘটনাস্থলে এসে উভয়পক্ষকে মুখোমুখি দেখতে পাই। পরে আমরা আমরা দুইপক্ষকে দুইদিকে সরিয়ে দিয়েছি। আপাতত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাহত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
এ ঘটনায় কেউ আহত হননি এবং কাউকে আটক করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এডিসি পলাশ কান্তি নাথ।
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার প্রায় একঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্রধান ছাত্রাবাসে যান চমেকের অধ্যক্ষ শাহেনা আকতার। তিনি ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রথমে বৈঠক করেন। এ সময় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও সহকারী অধ্যাপক রিজুয়ান রেহান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তারা ছাত্রাবাসের ভাংচুর হওয়া কক্ষগুলো ঘুরে দেখেন।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ শাহেনা আক্তার বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের বাইরে বহিরাগত কিছু শিক্ষার্থী অবস্থান নিচ্ছিল ছাত্রাবাসে। তাদের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। আমরা আগামীকাল (বুধবার) একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক ডেকেছি। ছাত্রাবাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম