মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান: ভারতের নীরবতা, কারণ কী?
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:১০ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০২:০৩
মিয়ানমারে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানালেও, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারত এ ব্যাপারে এক ধরনের কৌশলগত নীরবতা অবলম্বন করছে।
এর নেপথ্যে কী, তা খুঁজে দেখে মিয়ানমার থেকে প্রকাশিত দ্য ইরাবতি’কে জানিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক জয়ন্ত কলিতা। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য ওই ভারতীয় সাংবাদিকের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো—
India’s Muted Response to Myanmar Military Coup Seen as a Strategic Move#WhatIsHappeningInMyanmar#RejectMilitaryCoup#SaveMyanmar#2021uprising#Myanmarhttps://t.co/YRPTjj6YnZ
— The Irrawaddy (Eng) (@IrrawaddyNews) February 23, 2021
সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারত,অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মধ্যে চতুর্পক্ষীয় মন্ত্রী পর্যায়ের নিরাপত্তা সংলাপে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তার আগে, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতের মুখপাত্র বলেছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য, অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই, দেশটিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। একইসঙ্গে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবেও ভারত মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।
দুই দফায়ই ভারতের কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারে সেনা অভিযান এবং গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভ এবং দাবির বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছে। এমনকি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি দেশটির বেসামরিক নেতৃত্বের মুক্তি পর্যন্ত দাবি করেনি ভারত।
তো, এই অবস্থান নেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত কী প্রমাণ করতে চাইছে?
এক, নরেন্দ্র মোদির সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা প্রশাসনের সুসম্পর্কের কারণে ভারত এ ব্যাপারে নীরব থাকতে পারে। ২০১৯ সালের জুলাইতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেল মিং অন হ্লাইং ভারত সফর করেন। সে সময় ভারত এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিও সই হয়েছিল। এছাড়াও, দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া, সমুদ্রসীমায় যৌথ নজরদারি বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
এক্ষেত্রে, ভারতের নীরবতার আরেকটি কারণ হতে পারে চীন। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের মিত্রতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং আরাকান আর্মিকে (এএ) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চীন উসকে দিচ্ছে— এমন অভিযোগ উঠছে বহুদিন ধরেই। সর্বশেষ, কয়েকটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের নাম উল্লেখ না করে বলেছে, বহিঃশক্তি তাদেরকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। তাই, চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সহযোগী হিসেবে ভারত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে হয়তো পাশে চাইছে। তাই, সেখানকার সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে ভারতের এই নীরবতা।
অথচ, ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখি ১৯৮৮ সালের আগস্টে তৎকালীন বার্মার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের যে আন্দোলন সেখানে দিল্লির ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। সে সময় ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নির্বাচনে জয়লাভ করে বার্মার ক্ষমতায় বসেছিল। কিন্তু, তারপর থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বলয়ে চীনের প্রভাব যত বেড়েছে, ভারত ততই দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে।
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে ভারতের এই নীরবতার শিকড় কোথায়, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখি মোদির সরকারের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি হাতে নেয় ভারত সরকার। আর এইক্ষেত্রে ভারতের কৌশলগত মিত্র মিয়ানমার। আরও স্পষ্ট করে বললে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
এছাড়াও, মিয়ানমারে ভারত সরকারের নেওয়া কালাদান মাল্টি মডাল ট্রানজিট ট্রানসপোর্ট প্রকল্পটিও অভ্যুত্থানের ব্যাপারে নীরব ভূমিকার পেছনে কাজ করেছে। ওই কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতার সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দর সংযুক্ত হবে। পরে, কালাদান নদীপথে মিয়ানমারের শিন রাজ্য হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মিজোরাম রাজ্যে পণ্য পরিবহনের পরিকল্পনা রয়েছে।
তাই, চীন সমর্থিত আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমন করে এই কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মোদি সরকারের দরকার হবে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সমর্থন। সে কারণেই, সেনা অভ্যুত্থানের সমালোচনা এবং বেসামরিক নেতৃত্বের মুক্তি দাবি করে ভারত তার অবস্থান নষ্ট করতে চায়নি।
এর বাইরেও, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মিজোরাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে পাশে দরকার ভারতের। তাই, মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সেনা অভ্যুত্থান এবং তৎপরবর্তী গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের ব্যাপারে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে একধরনের কৌশলগত নীরবতা অবলম্বন করছে ভারত।
সারাবাংলা/একেএম
আরাকান আর্মি কালাদান প্রকল্প চীন টপ নিউজ ভারত মিজোরাম মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা