‘আমরা কি ময়লার চেয়েও মূল্যহীন?’
২৭ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:১০ | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:১৯
ঢাকা: রাজধানীর ডেমরার মাতুয়াইলে ল্যান্ড ফিল, তথা ডাম্পিং স্টেশনের নিরাপত্তা জোরদার করতে সম্প্রতি উঁচু প্রাচীর গড়তে শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তাতে ডাম্পিং স্টেশনের নিরাপত্তা জোরদার হোক না হোক, ওই এলাকায় ডাম্পিং স্টেশনের দুই পাশে গড়ে ওঠা শতাধিক কারখানার মালিকরা পড়েছেন বিপাকে। উঁচু এসব দেয়ালের কারণে কারখানায় কাঁচামাল প্রবেশ করানো যেমন কঠিন হয়ে পড়েছে, তেমনি কারখানায় উৎপাদিত পণ্যও বাইরে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
এসব কারখানার মালিকরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়েছে। এ অবস্থায় এসব কারখানার মালিকরা তো বটেই, কারখানাগুলোতে নিয়োজিত হাজারখানেক শ্রমিককে কাটাতে হচ্ছে অলস সময়। রুটি-রুজির চিন্তায় কপালে হাত পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীর। ডাম্পিং স্টেশনের নিরাপত্তা বিবেচনায় স্থানীয় সহস্র নাগরিকের উপার্জনের পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে আক্ষেপ জানিয়ে তারা বলছেন, ‘আমরা কি ময়লার চেয়েও মূল্যহীন?’
পুরো পরিস্থিতির জন্য ডিএসসিসি’র পরিকল্পনাহীনতাকে দায়ী করছেন মাতুয়াইলের এসব কারখানার মালিক-শ্রমিকরা। আর ডিএসসিসি বলছে, দেয়াল ওঠার পর যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা কোনো বিকল্প পথ বের করে নেবেন!
মাতুয়াইলে ডিএসসিসি’র ডাম্পিং স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। স্থানীয়রা জানালেন, কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিসহ বড় বড় কল-কারখানার যন্ত্রপাতির জন্য ছোট ছোট যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এসব কারখানায়। বৈধ মালিকানাধীন জায়গায় গড়ে ওঠা এসব কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চলছে প্রায় তিন দশক ধরে। এখানে উৎপাদিত লোহা ও ইস্পাতের যন্ত্রাংশ দেশীয় চাহিদা মেটানোর পর দেশের বাইরেও রফতানি হয়।
কারখানার মালিকরা বলছেন, প্রতি মাসেই তারা লাখ লাখ টাকা ভ্যাট দেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। তারা নিয়মিত আয়করও পরিশোধ করেন, পরিশোধ করেন ডিএসসিসি’র হোল্ডিং ট্যাক্সও। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা বা সুবিধা তারা পাননি। তা সত্ত্বেও সব আইন-কানুন মেনেই তারা কারখানা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ডিএসসিসির উঁচু প্রাচীর তোলার কার্যক্রমে তাদের এখন উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বলতে গেলে পথে বসার দশা।
এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দা ও কারখানার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিটি করপোরেশন ডাম্পিং স্টেশনের নিরাপত্তার নামে যে দেয়াল তুলছে, তা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। কারণ ডাম্পিং স্টেশনে ময়লা ছাড়া আর কিছুই নেই। ময়লা চুরি করবে কে? কিন্তু সেই ময়লার নিরাপত্তা দেওয়ার নামে প্রাচীর তুলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসাকে বন্ধ করা অবশ্যই একটি চক্রান্ত।
তাদের অভিযোগ, কারখানার স্বার্থে বিষয়টির নিষ্পত্তি চেয়ে তারা ডিএসসিসির মেয়র ও স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু তাদের অভিযোগের নিষ্পত্তির কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সরেজমিনে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন সংলগ্ন ময়লার রোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ডাম্পিং স্টেশনের পাশ ঘেঁষে দুই দিকে ১২ থেকে ১৬ ফুট চওড়া রাস্তা তৈরি হয়েছে। এই রাস্তার এক পাশে ডাম্পিং স্টেশন, অন্য পাশে ছোট-বড় শতাধিক কারখানা। সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা প্রাচীর ওঠায় এখন এসব কারখানার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রুদ্ধপ্রায়। কেননা কারখানাগুলোর দরজা বরাবর দেড় দুই ফুট উঁচু দেয়াল (ইটের স্তর) তোলা হয়েছে। আর যেসব জায়গায় দরজা নেই, সেসব জায়গায় তোলা হয়েছে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার প্রাচীর।
এ অবস্থায় কারখানায় ঢুকতে কিংবা কারখানা থেকে বের হতে দেয়াল টপকাতে হচ্ছে মালিক-শ্রমিক সবাইকে। দেয়াল টপকে যাতায়াত করা সম্ভব হলেও কাঁচামাল আনা-নেওয়া কিংবা উৎপাদিত পণ্য বের করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। শুধু তাই নয়, খুব শিগগিরই দেড়-দুই ফুটের দেয়ালগুলো আরও উঁচু প্রাচীরে পরিণত হবে— এমনটিই জানিয়েছে ডিএসসিসি।
স্থানীয় কারখানার মালিক ও প্যাকেজিং ব্যবসায়ী বিপুল রায় সারাবাংলাকে বলেন, যখন দেয়াল তোলার কাজ শুরু হয়, আমরা তাদের আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছিলাম। তখন তারা আমাদের বলেছিলেন, কারখানার দরজা বরাবর পকেট গেটের মতো করে পথ রাখবেন। বাকি জায়গায় প্রাচীর তুলবে। এতে কারখানাগুলোতে ঢোকা ও কারখানা থেকে বের হওয়ার পথ যেমন থাকবে, তেমনি নিরাপত্তার প্রাচীরের কাজটিও চলবে। তাতে আমরা আমরাও রাজি ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ গতকাল (মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারি) ডিএসসিসি’র ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে দরজার সামনেও প্রাচীর তোলা শুরু হয়। পরে আমরা সবাই এক হয়ে বাধা দিলে আমাদের বেশ কয়েকজন লোককে পুলিশ আটকও করে, যদিও সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দিয়েছে।
আরেক কারখানার মালিক মাসুদ রানা সেলিমও একই অভিযোগ করেন। তাকিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশনের এই মালিক সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কারখানার সামনে দেয়াল তোলার ঘটনায় আমরা সবাই মিলে আমাদের কাউন্সিলর, এমপি ও ডিএসসিসির মেয়র মহোদয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করি। কিন্তু অভিযোগ করার পরও এখানে আমাদের কারখানার দরজার সামনে দেয়াল তোলা শুরু হয়েছে। এতদিন তো দরজার জায়গা খালি রেখে বাকি অংশটুকুতে দেয়াল তুলছিল, গতকাল দরজার খালি জায়গাতেও দেয়াল তোলা শুরু হয়েছে। এতে আমরা বাধা দিলে তারা আমাদের জানান, মেয়রের নির্দেশেই তারা এটা করছেন।
মাসুদ রানা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে যদি এটা করা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা যাব কোথায়? আমাদের বৈধ কারখানা বন্ধ করলে আমরা কী করব? আমাদের কারখানাগুলোতে হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করে। তারা যাবে কোথায়? তাই আমার মনে হয় মেয়র মহোদয়কে কেউ বিষয়টি ভুলভাবে বুঝিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, আমরা আমাদের মেয়র তাপস সাহেবকে যে মনের মানুষ মনে করি, তাতে ময়লাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি আমাদের এমন কঠিন সমস্যায় ফেলবেন না। তিনি যদি একবার এ জায়গায় আসেন, তাহলে সব সমস্যা হয়ে যাবে— এটা আমাদের বিশ্বাস।
এখানকার আরেক ব্যবসায়ী ফারুক আলম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা নিয়মিত ভ্যাট-ট্যাক্স ও ডিএসসিসিকে কর দিয়ে যাচ্ছি। সম্পূর্ণ বৈধভাবে কারখানা চালাচ্ছি। এখানকার একেকটি কারখানা মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করে। পাশাপাশি বাৎসরিক আয়কর তো আছেই। ডিএসসিসিকেও নিয়মিত কর পরিশোধ করি। এত কিছুর পরও ডিএসসিসি যদি ময়লাকে প্রধান্য দিয়ে আমাদের চলার পথ আটকে দেয়, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা কি ময়লার চেয়েও মূল্যহীন?
কারখানাগুলোতে কর্মরত বেশকিছু শ্রমিকের সঙ্গে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কথা হয়। রুটি-রুজি নিয়ে শঙ্কায় থাকা এসব শ্রমিকরাও বলেন, কারখানা বন্ধ হলে আমরা যাব কোথায়? আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের বিপদে ফেলবেন না। সমস্যাটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোর আহ্বান জানান তারা।
কারখানা শ্রমিক বয়োবৃদ্ধ সুফিয়া আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহু বছর ধরে এখানে কাজ করি। এ কাজের টাকায় সংসার চলে। কিন্তু আজ কয়েকদিন ধরে কারখানার কাজ চলছে না। শুনতেছি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুফিয়া বলেন, ‘কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে যামু কই? কাজ পামু কোথায়? ছেলে-মেয়েদের খাওয়ামু কী?’
বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে ভুক্তভোগী কারখানা মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় মানববন্ধন করবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফি উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের জায়গা আমরা সুরক্ষিত করছি। তাদের অনেকবার বলা হয়েছে, যেন তারা যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করে। কিন্তু এতদিনেও তারা সে কথায় কর্ণপাত করেনি। এখন যেহেতু আমরা দেয়াল তুলে দিচ্ছে, সেহেতু তারা সবাই মিলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করেন নেবে।’
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর
অপরিকল্পিত দেয়াল কারখানা মালিক কারখানা শ্রমিক টপ নিউজ ডাম্পিং স্টেশন ডিএসসিসি ঢাকা দক্ষিণ সিটি মাতুয়াইল ল্যান্ড ফিল