Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওই মহামানব আসে…


১০ জানুয়ারি ২০২১ ১২:৪৬

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের পূর্ণতা পায় বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমপর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। চারদিকে বিজয়ের উল্লাস। কিন্তু এর মাঝেও যেন বিরাট শূন্যতা। কারণ সেই মহানায়কের অনুপস্থিতি। যিনি যুদ্ধের ন’মাস পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে হত্যাষড়যন্ত্র মাথায় নিয়ে প্রতি মুহূর্ত পার করেছেন। আন্তর্জাতিক চাপে ৮ জানুয়ারি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অত্যাচারী পাকিস্তান সরকার। এরপর লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এরপরই মূলত বিজয়ের আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয় স্বজন হারানো বাঙালি।

বিজ্ঞাপন

মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাদের স্বার্থের রক্ষক বলে জেনেছিল। তিনি তা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন। ১৯৭১ এর ২ শে মার্চ। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাঙালিও আর থেমে থাকেনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করতে নেমে পড়ে যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ওই রাতেই পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ফের প্রাণ সংশয়ে পড়েন তিনি। তবে দমলেন না।

মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস তিনি অনুপস্থিত, কিন্তু তার সেই ডাক-ই মানুষের প্রেরণা ছিল সর্বক্ষণ। ৭ই মার্চে রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে তার বজ্র কণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক শুনতে পেয়েছিল মানুষ। তাই ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রু’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করে তারা। ৭ই মার্চের ভাষণ আজ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি।

বিজ্ঞাপন

তার নামেই মানুষ যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে, বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং হানাদারদের সকল হিংস্রতা ও বর্বরতাকে মোকাবিলা করেছে। যুদ্ধের ন’মাস তাদের মুখে স্লোগান ছিল, ‘ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। এটি ছিল বাঙালির রণধ্বনি। আজ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছি আমরা।

তিনি যেমন মানুষের কষ্ট প্রকাশের প্রতিনিধি ছিলেন, মানুষ তাকে নেতৃত্বের আসনে সামনে বসিয়ে তার বক্তৃতা শুনে সাহস সঞ্চয় করে মুক্তিযুদ্ধেসহ সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। তারই যোগ্য উত্তরসুরী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ওই নয় মাস নেতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংসার-জীবন ত্যাগ করে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। একইভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। দেখলেন তার অপেক্ষায় লাখ লাখ মানুষ ঢাকার রাজপথে। কখন আসবেন প্রিয় ভূমিতে প্রিয় মানব। তিনি এলেন, দেখলেন তার বাংলাকে। তার সোনার বাংলা তখন বিধ্বস্ত। যার অর্ধেক সম্পদ একটি গোষ্ঠী নৃশংসভাবে ধ্বংস করেছে। শিল্পসম্পদের ৪৭ শতাংশ পেলেন পরিত্যক্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামো। দুই বছরের পশ্চাদপদতা। উত্তরাধিকার হলো ভারতে আশ্রিত নাগরিক, আর দুই কোটি গৃহহারা মানুষ। লণ্ডভণ্ড ব্যবসা-বাণিজ্য, ছিন্ন হয়ে গেছে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় সব সূত্র।

প্লেন থেকে তখনও নামেনি, জানালা দিয়ে মানুষে স্রোত দেখে অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই মানুষকে আমি খাওয়াবো কী? তবে বাংলার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন।

দেশে ফিরে আসার বঙ্গবন্ধুর প্রধান কর্তব্য ছিলো-গৃহহারাদের পুনর্বাসন। দ্বিতীয় কর্তব্য-বিরান ভূমিতে পরিণত করা দেশটিতে জীবন ধারণের পরিবেশ সৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ-অনাহার পরিহার করে জনগণকে বাঁচিয়ে রাখা। ফরজ হলো যুদ্ধ করে বিভক্ত দেশটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিচিতি তৈরি করা।

এছাড়া মিত্র বাহিনীর সদস্যদের দেশে ফেরানো, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, ব্যবসা-বাণিজ্য পুনর্বহাল, বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবস্থাগ্রহণ। তার অন্যতম দায়িত্ব দেশে দক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি মৌলিক আইনের প্রবর্তন। আর এ সব কাজ বেশ সুষ্ঠুভাবেই করেছিলেন জাতির পিতা। আর তা করেছেন নিজের জীবদ্দশাতেই। এই হিসেবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শুধু জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা নন, এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠায়ও রয়েছে তার অনন্য অবদান।

দেশে ফিরে প্রথম প্রেস কনফারেন্সেই বঙ্গবন্ধু তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক চাই। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে, এখানে বৈরিতার কোনো সুযোগ নাই। এখন হলো দেশ গড়ার পালা। এ অঞ্চলে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পরিবেশই হলো সবচেয়ে উপাদেয়। আমি আমার বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য আমি সকলের সাহায্য চাই।’

সবার আগে জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন তিনি। তাই তো চীন, মিশর এবং সৌদি আরব- দেশ তিনটি তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এরপরও তাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের হাত প্রসারিত করেন। মানুষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে সৌদির সঙ্গে হজযাত্রী পাঠানোর চুক্তি করেন।

জন্মভূমিতে নেমেই একে সোনার বাংলায় রূপান্তরের ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১০ জানুয়ারির জনসভায় বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলে ছিলেন, ‘এখন যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না।’

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে তিনি সেদিন বলেছিলেন, গত ২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের প্রায় সর্ব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বর্বর পাকবাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।

দেশের ভবিষ্যত রাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’

‘বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার’ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন লাল-সবুজের এই দেশটির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যে দেশ পুনর্গঠনের জন্য তাঁর সরকারের করণীয় অনেক বিষয়ই উল্লেখ ছিল।

সরকারের কর্মপরিকল্পনা প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের নীতি হইতেছে সকলের সহিত বন্ধুত্ব। কাহারো সহিত বিধ্বস্ত পরায়ণতা নয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হইবে জোট নিরপেক্ষ।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দিনটি সমগ্র জাতির জন্য শিক্ষণীয় একটি অধ্যায়ও বটে। মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায়ে দৃঢ় চিত্তে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা।

বর্তমানে তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলছেন। অবস্থায় আজও দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার উচিত- বিপুল ত্যাগ স্বীকার করা। নিজের কাজটি ভলোমতো করে যাওয়া। দেশপ্রেমের কোনো বিকল্প নেই।

বঙ্গবন্ধু আজীবন মানুষের কথা চিন্তা করেছেন। চেতনা ও মননেও রয়েছে মানুষের কথা। তাঁর জীবন- সংগ্রাম পর্যালোচনা করলে খোঁজ মেলে তিনি যেমন আজীবন মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তেমনি তাঁর ছিলো বিশ্বমানবতাবাধ , বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, বিশ্বমানব ঐক্যবোধ এবং বিশ্বশান্তি।

বিশ্বমানবতাবোধ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

‘ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধুলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-
এল মহাজন্মের লগ্ন।’

এই অঞ্চলে একজন মহামানব এসেছিলেন, যার হৃদয় ছিল বিশ্বের সমান। তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান এই নেতার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর। ই-মেইল: [email protected]

জাতির পিতা টপ নিউজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর