দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুর: প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন নওফেল
৯ জানুয়ারি ২০২১ ২০:৪৯ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৩৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দখল বুঝে নেওয়ার নামে হঠাৎ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ঐতিহাসিক ভবনটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার (৯ জানুয়ারি) বিকেলে নগরীর রহমতগঞ্জে ভেঙে দেওয়া ঐতিহাসিক বাড়িটি পরিদর্শনে যান স্থানীয় চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের সাংসদ উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
উপমন্ত্রী বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে দেখতে পান, আঙিনায় চেয়ার নিয়ে বসে আছেন বেশ কয়েকজন নারীপুরুষ। আঙিনার পরে আরেকটি ছোট ফটকের ভেতরে বেশকিছু নারীকেও দেখেন তিনি। উপমন্ত্রীকে দেখে প্রথমে এক নারী এসে নিজেকে এম ফরিদ চৌধুরীর (দখলদার) স্ত্রী পরিচয় দেন। পরে এম ফরিদ চৌধুরী সামনে আসেন। তখন উপমন্ত্রী বাড়ি ভাঙার কারণ জানতে চান।
ফরিদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আদালত থেকে রায় পেয়েছি। আদালত ভেঙেছে, আমরা ভাঙিনি।’ জবাবে উপমন্ত্রী বলেন, ‘রায় যেটাই পান, বাড়ি ভাঙার তো অধিকার নেই। রায় দেওয়ার পর আদালত পজিশন বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু ভেঙে তো বুঝিয়ে দেয় না। এই বাড়িটার ঐতিহাসিক মূল্য আছে। পুরাকীর্তি হিসেবে এটা সংরক্ষণ হওয়ার মতো ভবন। এটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হল কেন? এটা খুবই অন্যায় কাজ হয়েছে।’ তখন ফরিদ বলেন, ‘সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটা আমরা মেনে নেব।’
এরপর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন উপমন্ত্রী নওফেল। তিনি বলেন, ‘এখানে একটা পক্ষ বলছেন যে, আদালত থেকে তারা রায় পেয়েছেন। আদালত থেকে রায় হওয়ার পর তো জায়গার পজিশন বা অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বুঝিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে কীভাবে ভাঙচুর হলো, কীভাবে পুরাতন একটা স্থাপনাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে- মনে হচ্ছে এখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। রায়টা কতটুকু, কি হয়েছে সেটা বিবেচনা করতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে, রায়ের ভিত্তিটা কী সেটা দেখতে হবে। কিন্তু পজিশনে কে থাকবে অথবা থাকবে না সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই আদালত দেবেন।’
‘কিন্তু হঠাৎ করেই একটি ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে দেওয়া একেবারেই গর্হিত কাজ হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এটা বেআইনি। এই স্থাপনার হেরিটেজ হিসেবে একটা মূল্য আছে, সেটাকে সম্মান দেখানো উচিৎ ছিল। সেটা ভেঙে দেওয়ার পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে। দখল বুঝিয়ে দেওয়া বা বুঝে নেওয়ার নামে হঠাৎ করে ভবনটা ভেঙে ফেলা হয়েছে, এটা একেবারেই আমার কাছে দুরভিসন্ধিমূলক মনে হয়েছে’- বলেন নওফেল।
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা মালিকানা সূত্রে যিনিই পান, সেটা ভেঙে ফেলার অধিকার কিন্তু কারও থাকে না। এমনকি সেই স্থাপনা সরকারিভাবে সংরক্ষিত ঘোষণার আগ পর্যন্তও যদি কেউ ভাঙার চেষ্টা করে, সামাজিকভাবে সেটা প্রতিহত করার একটা রেওয়াজ আমরা আমাদের দেশে অতীতেও দেখেছি। আর এই জায়গাটা যতটুকু জানি একটা অর্পিত সম্পত্তি। আমার সন্দেহ হচ্ছে- জেলা প্রশাসনকে পক্ষভুক্ত না করেই এটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অর্পিত সম্পত্তি কীভাবে ব্যক্তি মালিকানায় গেলো সেটাও তদন্ত করে দেখতে হবে।’
জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে নওফেল বলেন, ‘একজন নাজির এসে নাকি জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কাগজপত্রে যা দেখেছি, উনার তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল না। তবে তারা বলছেন যে, আদালতের রায়ের বিষয়। সেখানে আদালতের রায়টা কী, সেটা আমাকে দেখতে হবে। অর্পিত সম্পত্তির কেয়ারটেকার জেলা প্রশাসন, তাদের না জানিয়ে কীভাবে জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সেই বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনের দেখা দরকার ছিল। নাজিরের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল কিনা, সেটাও পুলিশের দেখা দরকার ছিল।’
ভবনটিতে গড়ে তোলা ‘শিশুবাগ স্কুল’ জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটা স্কুলের যখন অনুমতি থাকে, তখন পাঠদানের অনুমতি থাকে, একাডেমিক অনুমোদন থাকে- এতগুলো সরকারি স্বীকৃতি থাকার পরও কীভাবে হঠাৎ করে সেটাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসন অবগত ছিল না, সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে এখানে অনেক ষড়যন্ত্রমূলক কাজ হয়েছে।’
সার্বিক বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক বাড়িটিকে জাদুঘর করার দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে অবশ্যই আমি ভূমিকা রাখব। যাত্রা মোহন সেন মানে জে এম সেন হলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসে অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তিনি আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও এখানে এসে প্রোগ্রাম করেছিলেন। সুতরাং উনি অনেক আগে থেকেই অবগত আছেন যে, জে এম সেনের বাড়ির ঐতিহাসিক মূল্য আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি বিষয়টি উনার দৃষ্টিগোচর করব। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও দৃষ্টিগোচর করব। জাদুঘর করার বিষয়ে সেখান থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও বাড়ির ভেতরে ‘দখলদার’ এম ফরিদ চৌধুরী ও তার লোকজনের অবস্থানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভেতরে যারা অবস্থান করছেন, তাদের বৈধতাটা কী সেটা একটু দেখতে হবে। এখানে তো একটা স্কুল ছিল। তাহলে এখন যারা এখানে অবস্থান করছেন, তারা কীসের ভিত্তিতে, কবে থেকে আছেন সেটা একটু দেখতে হবে। আমি এ বিষয়ে পুলিশের উদ্যোগী হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।’
গত ৪ জানুয়ারি এম ফরিদ চৌধুরী নামে একজন আদালতের কাছ থেকে মালিকানা সংক্রান্ত দখলি আদেশ পেয়েছেন দাবি করে তার লোকজন বুলডোজার নিয়ে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের (যতীন্দ্র মোহনের বাবা) বাড়িটি ভাঙতে যান। এসময় পুলিশের উপস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষকদের জোরপূর্বক সেখান থেকে বের করে দিয়ে ভবনটির একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত স্থানীয়দের নিয়ে ভবনটির সামনে অবস্থান নেন। প্রতিরোধের মুখে তখন ভবন ভাঙা বন্ধ রাখা হয়।
এরপর ৬ জানুয়ারি ওই বাড়ির দখল ও অবস্থানের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জেলা প্রশাসনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত থেকেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবে আদালতের আদেশের পরও ওই জায়গায় এম ফরিদ চৌধুরীর লোকজন সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন। এমনকি উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পরিদর্শনের সময় ভবনটি ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেওয়া এম ফরিদ চৌধুরীর জামাতা হিসেবে পরিচয়দানকারী গিয়াসউদ্দিন সুজন এবং মিজানুর রহমান সেখানে ছিলেন।
টপ নিউজ দেশপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বাড়ি ভাঙচুর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শেখ হাসিনা