‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আর দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুর একই সূত্রে গাঁথা’
৮ জানুয়ারি ২০২১ ২২:১৫ | আপডেট: ৮ জানুয়ারি ২০২১ ২২:৩৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য এবং দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙচুর একইসূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মুছে ফেলার চক্রান্ত থেকে মৌলবাদীরা নানা কৌশলে এই ভাঙচুর চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) বিকেলে নগরীর চেরাগি পাহাড় মোড়ে দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদে ‘চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকবৃন্দ’ আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে দেশপ্রিয়র বাড়ির সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছেন রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা।
সমাবেশে সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. শাহআলম বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে যাত্রামোহন (দেশপ্রিয়র বাবা) সেনগুপ্তের বাড়ির আইনি জটিলতা নিরসনের জোর দাবি জানাই। এজন্য সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব স্থাপনাকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তুলে ধরতে হবে। অবিলম্বে ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙচুরকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’
আরও পড়ুন-
- দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুরকারীদের গ্রেফতার দাবি
- দেশপ্রিয়র বাড়ি ভেঙেছে প্রশাসন, দাবি ‘দখলদারের’
- দেশপ্রিয়র বাড়ি রক্ষায় আদালতে গেল জেলা প্রশাসন
- দেশপ্রিয়র বাড়ি রক্ষায় আদালতে যাবেন বিশিষ্টজনেরা
- ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের স্মৃতি স্থাপনা ভাঙার ওপর স্থিতাবস্থা
- ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের স্মৃতি স্থাপনায় বুলডোজারের আঘাত
- দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুর: বিচারপতির মাধ্যমে তদন্ত চান সুজন
মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা ভাঙচুরকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। কারণ ভাঙচুরকারীদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা যদি আদালতের রায়ে সম্পত্তির দখল পেয়েও থাকে, দখলে নেওয়া মাত্র বাড়ি ভাঙতে হবে কেন? এতে বোঝা যায় তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবীর বাড়িটি ভেঙে ফেলা।’
নারীনেত্রী নুর জাহান খান বলেন, ‘চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপনায় দিনেদুপুরে বুলডোজার দিয়ে আঘাত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন ভূমিদস্যুরা। তাদের এই স্পর্ধার জবাব দিতে হবে।’
একাত্তরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবছার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল সরকারে থাকা অবস্থায় কেন এমন হচ্ছে বারবার? বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে, বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙছে, যাত্রামোহন সেনের বাড়ি ভাঙচুর করছে। এত দুঃসাহস কাদের? সব ভাঙচুরের ঘটনা একইসূত্রে গাঁথা। একদল মৌলবাদী নানা কৌশলে এ দেশকে সিরিয়া-পাকিস্তান বানাতে চায়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকতে এ দেশ সিরিয়া-পাকিস্তান হবে না।’
খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘লালনের ভাস্কর্য ভেঙেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। এসবে প্রশ্রয় পেয়েছে বলেই এবার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ির ওপর আঘাত এসেছে। আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে আপস হয়েছে বলেই ভূমিদস্যুরা এ সুযোগ পেয়েছে।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘ভূমিদস্যুরা প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই ভাঙচুর চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এসব স্মৃতিচিহ্ন ঐতিহ্য এবং বধ্যভূমি রক্ষা করতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে। সম্মিলিতভাবে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে হবে।’
খেলাঘর কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান মানুষের জন্য, যারা সংবিধান মানে না তারা পশু। মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সংবিধানবিরোধী এমন কর্মকাণ্ড মানা যায় না। দেশে গণতন্ত্র আছে বলা হলেও এখানে চলছে লুটপাট। আর লুটপাট ও সুশাসন একসঙ্গে চলে না। আমরা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও যাত্রামোহন সেনের বাড়ি রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
নাগরিক সমাবেশের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক প্রীতম দাশ। দাবিগুলো হচ্ছে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙচুরকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করা এবং ভাঙচুরের বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ঐতিহাসিক বাড়িটিসহ দেশপ্রিয়র সম্পত্তি সরকারিভাবে অধিগ্রহণ এবং সেখান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাদুঘর স্থাপন করা ও সেখানে অতীতের সকল ইজারা বাতিল করা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করা, মাস্টারদা সূর্যসেনসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সব যোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ এবং পাঠ্যপুস্তকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঠিক ইতিহাস যুক্ত করা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্ম ও মৃত্যুদিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের গ্রন্থাগার সম্পাদক মিন্টু চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি উত্তম চৌধুরী, জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, উদীচী সংগঠক শীলা দাশগুপ্তা, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদ হাসান, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সিপিবি চট্টগ্রামের নারী সেলের আহ্বায়ক রেখা চৌধুরী, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সাংবাদিক আলীউর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক রাসেল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের টিভি ইউনিটের প্রধান মাসুদুল হক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সিঞ্চন ভৌমিক, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক আহমেদ মুনীর চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী।
সমাবেশ শেষে নগরীর রহমতগঞ্জে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি পর্যন্ত নাগরিক পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কমর্সূচি সমাপ্ত ঘোষণা করেন সিপিবির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা। কর্মসূচিতে সংহতি জানায় মহিলা পরিষদ, খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, নাট্য সংগঠন ফেইম।
ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মুছে ফেলার চক্রান্ত খেলাঘর কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবছার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের গ্রন্থাগার সম্পাদক চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকবৃন্দ টপ নিউজ ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত দেশপ্রিয়র বাড়ি ভাঙচুর নারীনেত্রী নুর জাহান খান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বাড়ি ভাঙচুর মাহফুজুর রহমান মিন্টু চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র মো. শাহআলম সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক