‘বায়ুদূষণে রাজধানীর পরিবেশ বাইরে বের হওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে’
২২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৩২ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ১৮:৫৯
ঢাকা: রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে ঢাকার ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের’ মান ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগের বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে রাজধানীর পরিবেশ দিন দিন ঘরের বাইরে বের হওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এতে চরম হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সারাবাংলাডটনেটের বিশেষ আয়োজন সারাবাংলা ফোকাসে ‘বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা তাদের এই উদ্বেগের কথা জানান।
সারাবাংলাডটনেটের সাংবাদিক রাজনীন ফারজানার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী এবং পরিবেশবিদ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
আলোচনার শুরুতেই ডা. লেলিন চৌধুরী রাজধানীর বায়ুদূষণের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২১ ডিসেম্বর, সোমবার রাজধানীর বায়ুমান বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ছিল ৩২৩, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যেখানে শুধু বায়ুদূষণজনিত অসুস্থ্যতার কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ মারা যায়, সেখানে এ পরিস্থিতি উন্নয়নে পরিবেশ অধিদফতর ও রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন তেমন কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ করেন ডা. লেলিন। তিনি বলেন, ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পে যে ৮০২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তাতে দেশের বায়ুমানের ওপর ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো বিশ্ব বায়ুমান ইনডেক্সে বাংলাদেশ দিন দিন খারাপ দিকেই যাচ্ছে।’
ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা প্রায় ২০ ভাগ বেড়েছে।’ এছাড়া বায়ুদূষণ যেভাবে বাড়ছে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে গিয়ে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণার অবস্থায় চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তাই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা এখন জরুরি বলেও মনে করছেন ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
এ বিষয়ে মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধ করতে চাইলে অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। এরসঙ্গে শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয় নয়, আরও অনেক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা জড়িত। এ বিষয়ে সরকার বেশ সচেতন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কি করণীয় তা এরইমধ্যে ঠিক করা হয়েছে।’
এছাড়া বায়ুদূষণ কমানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। স্বল্পমেয়াদী কাজের মধ্যে রয়েছে নির্মাণকাজের সময় পানি ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী সংরক্ষণ ও পরিবহনের সময় ঢেকে রাখা, কালো ধোঁয়া সৃষ্টিকারি গাড়িগুলো সড়ক থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়াসহ রাজধানীর আশপাশের ইটভাটাগুলো ভেঙে দেওয়া।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, ‘২০২২ সালের মধ্যে রাজধানীর বড় প্রজেক্টগুলো শেষ হয়ে গেলে ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। তখন বায়ুমানেরও অনেক বেশি উন্নতি হবে, যা দৃশ্যমান হবে। আগামী দুই থেকে তিন বছরে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান ১০০-১৫০ এর মধ্যে চলে আসবে বলেও আশাপ্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া ২০৩২ সালের মধ্যে সব ধরনের নির্মাণকাজে ইটের ব্যবহারের পরিবর্তে ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা জানান তিনি।’
এ বিষয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন পরিবেশ অধিদফতর যে স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পগুলো নিয়েছে তা মূলত হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য। অধিদফতরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘তাদের কাজ যেন মুখরক্ষার জন্য না হয়, বায়ুদূষণ কমিয়ে এদেশের মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষা, বর্তমান জীবন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করাই যেন পরিবেশ অধিদফতরের মূল লক্ষ্য হয়।’
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রকল্প যেমন ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেইস) প্রকল্পে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে ৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে তা যেন হরিলুট না হয়।’
এছাড়া বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া নানা প্রকল্পে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, ‘জনসাধারণকে যুক্ত করে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য যে স্রোত তৈরি করা দরকার, কোনো মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের কাজে এ উদ্যোগ দেখা যায়নি।’ তাছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করে মানুষকে ভালো রাখার যে প্রক্রিয়া, সেখানে কর্তৃপক্ষ এখনো উদাসীন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করতে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাসের জন্য আলাদা পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার। কারণ ঢাকা শহরে সারাবছর যে বায়ুদূষন হয়, তার ৬০ ভাগ হয় এই চার মাসে। বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সক্ষমতা ব্যবহার করেই এ চারমাস বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব। যেমন, পুলিশ প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসার গাড়ি দিয়েই এখন পানি ছিটানো সম্ভব। এভাবে প্রায় ২০ শতাংশ বায়ুদূষণ কমানো যায় বলে তাদের একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে এয়ার পল্যুশন কন্ট্রোল কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি। এছাড়া সারাদেশের বায়ুদূষণ দেখভাল করার জন্য পরিবেশ অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার এবং সেজন্য বিসিএসে পরিবেশ ক্যাডার অবশ্যই যুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন কামরুজ্জামান।
জিয়াউল হক বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধ করতে চাইলে অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। এরসঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা জড়িত আছে।’ এছাড়া পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস এসব নানা সংস্থার সমন্বিতভাবে চেষ্টা করছে বলেই এ কাজে সময় একটু বেশি লাগছে বলেও জানান তিনি।
তবে বায়ুদূষণ থেকে সহসা মুক্তি পাচ্ছে না শহরবাসী। যতদিন বায়ুদূষণ থাকবে ততদিন নিজেকে সুস্থ্য রাখার জন্য নগরবাসিকে কিছু বিষয় মেনে চলার পরামর্শ দেন ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাস্ক যেমন কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কাজ করে, তেমনি বায়ুদূষণের বিরুদ্ধেও ভালো কাজ করে।’ এছাড়া নিজের ও আশপাশের মানুষের জন্য যাতে পরিবেশ দূষিত না হয় সেদিকে সবাইকে সচেতন থাকার আহবান জানান তিনি।
পাশাপাশি জনগণকে যুক্ত করে, পর্যাপ্ত জনবল নিয়ে এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নতুন বছর শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন অতিথিরা।
এভাবে একটি গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সারাবাংলা ফোকাসের এ পর্বের আয়োজন।
[প্রসঙ্গত, সারাবাংলা ফোকাস সপ্তাহের প্রতি শনি, সোম এবং বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে সারাবাংলাডট নেটের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ সম্প্রচারিত হয়]