Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ভাস্কর্যকে ঘিরে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতির অপব্যবহার চলছে’


২৫ নভেম্বর ২০২০ ২১:০৫ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০ ০৮:৪৬

ঢাকা: ভাস্কর্য স্থাপনের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে থাকতে পারে। ধর্মকে এভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করতে গেলেই সংকট তৈরি হয়। সেটুকু বাদ দিলে ইসলামি দেশগুলোতেও ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কেননা ভাস্কর্য ও মূর্তি— দু’টি ভিন্ন বিষয়। ভাস্কর্য তৈরি করা হয় কোনো ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ কিছুকে শ্রদ্ধা বা সম্মাননা জানানোর জন্য। অন্যদিকে মূর্তি তৈরি হয় পূজা করার জন্য। ভাস্কর্য যদি ধর্মবিরোধই হতো, তাহলে মক্কা-মদিনার ইমামসহ ইসলামি বিশ্বের শীর্ষ আলেমরাই এর বিরুদ্দে কথা বলতেন। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনকে ঘিরে যে বিতর্ক, সেটি মূলত ধর্ম ব্যবহার করে রাজনীতি। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, তাকে নিয়ে এ ধরনের কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৫ নভেম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন সারবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘ভাস্কর্য-মূর্তি-প্রতিমা এবং বাংলাদেশ’।

সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানীর সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। অনুষ্ঠানটি একযোগে সারাবাংলা ডটনেটের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন- প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর নামে মন্দির করুন, মূর্তি নয়: মাওলানা আতাউর

অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যেখানে স্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে দুইটি মসজিদ রয়েছে। এ বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ‘উনি (মাওলানা গাজী আতাউর রহমান) বলছেন কাছে মসজিদ আছে। কিন্তু উনাকে যদি প্রশ্ন করি, বায়তুল্লাহ শরীফের উত্তর-পূর্ব পাশেই হজরে আসওয়াদ নামে একটি পাথর রয়েছে। সেই পাথরে সারাবিশ্বের মুসলমানরা ‍চুমু খাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেই পাথরের কি কোনো ক্ষমতা আছে? এ জন্য পাথরকে চুমু খাওয়া হয় যে রাসুল (সা.) ওই পাথরে চুমু খেয়েছেন।’

তিনি বলেন,  ‘স্বয়ং কাবা শরীফে একটি পাথর রয়েছে যেখানে আমরা চুমু খাই, সেটাকে সম্মান করি। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভাস্কর্য, ৩০ লাখ শহিদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার— তাদের জন্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলোতে গিয়ে আমরা কেউই প্রার্থনা করি না, আরাধনা করি না। ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্য যদি হারাম হতো, তাহলে কাবা শরিফের ইমাম সাহেব, মদিনা শরিফের ইমাম সাহেব সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব দেশের ইসলামি চিন্তাবিদেরা এটার বিরুদ্ধে কথা বলেন না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, উনি (মাও গাজী আতাউর রহমান) ডিকশনারির কথা বলছেন তো। ডিকশনারি শব্দ দিয়ে ধর্ম নিরূপণ করা যায় না। ইংরেজিতে গড বলতে সৃষ্টিকর্তাকে বুঝায়। গডের কিন্তু স্ত্রী লিঙ্গও আছে। কোনোভাবেই ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা যাবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামের ধ্বজাধারী কারা তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আলেম সমাজের কার কী ভূমিকা ছিল, তা প্রমাণিত। এ দেশের মানুষ একাত্তরেও আপনাদের চিনতে ভুল করেনি, এখনও ভুল করবে না। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান অত্যন্ত সচেতন। ধর্মের অপব্যখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাসকে, শ্রদ্ধা নিবেদনকে আপনারা বন্ধ করতে পারবেন না।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমরা যদি সহজেই বলি— ভাস্কর্য ও প্রতিমা দু’টি আলাদা বিষয়। সহজ মানে আমরা এইভাবে বুঝি— প্রতিমা মানে আপনি তাকে সামনে রেখে তার কাছে প্রার্থনা করছেন। ভাস্কর্য প্রধানত সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অথবা কারও প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। প্রতিমার কাছে দাঁড়িয়ে যে ধরনের ইহলোক বা পরলোকের প্রার্থনা করা হয়, ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা করা হয় না। ধর্মীয় আলেমদের মধ্যে এটি নিয়ে তাদের মধ্যে হয়তো মতপার্থক্য রয়েছে। বিদেশ যাওয়া দরকার নেই, আমরা যদি গুগলে তুরস্ক, লেবানন, মিশর, ইরান, ইরাকের মতো মুসলিম দেশগুলো দেখি, তাহলে দেখব তাদের ওখানেও বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য রয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র ভাস্কর্য রয়েছে। সেটা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বা কোনো ব্যক্তি বা বিশেষের প্রতি সম্মান জানানোর জায়গা। আমাদের থেকে আরও বেশি ইসলামপ্রিয় দেশেও ভাস্কর্য রয়েছে, সেখানে তো এই সংকট দেখছি না।’

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ধর্মীয় আলেমদের আরও বেশি ভেবে দেখা দরকার। যারা প্রকৃত ধর্মের অনুসারী, তাদের ভেবে দেখা দরকার। আমরা কোন দেশে বসে কথা বলছি— বাংলাদেশ। বাংলাদেশে অনেক কিছু দেখেছি আমরা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আগে আমরা দেখেছি ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার। ধর্মকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। আমরা বিশ্বাস করি— বাংলাদেশের মসুলমানরা প্রকৃত ধর্মের অনুসারী, বাংলাদেশের আলেমরা সেটা করতে চান না। এটাকে যদি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, তখন সংকটটা তৈরি হয়। আমার ধারণা— কেউ বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, সচেতনভাবে হোক বা অসচেতনভাবে হোক— তারা হয়তো কোনো একটি গোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়ে এই কথাগুলো বলছেন। কথা বলার বহু জায়গা আছে, কিন্তু বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়েই কথা হচ্ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘এই আলোচনাগুলো আগেও এসেছে। এবার করোনার সময়ে আবারও এলো। আর সেটি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছিলাম? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি একটা আইডেনটিটি, আমরা কিভাবে পরিচিত হবো সেটা নির্ধারণ করার জন্য। সেই পরিচয়টি হচ্ছে, আমি বাঙালি। জাতির পিতা আমাদের যে সংবিধানটি দিয়েছেন, সেই সংবিধানের চারটি স্তম্ভ। সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। তাহলে আমি যে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলছি, সেটার আলোকে যদি আসি— ভাস্কর্য কিংবা প্রতিমার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্য একটি শিল্প। পদ্মাসেতু আমাদের নিজস্ব অর্থে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করেছি। সেখানে আমরা জাতির পিতার একটি ভাস্কর্য করতে চাই। সেটাই তো আমাদের একটি বড় সৌন্দর্য। আপনি মালয়েশিয়ার দিকে তাকান, সেখানে মসজিদ ও মন্দির পাশাপাশি। সেখানে এসব বিষয় নিয়ে কোনো ধরণের বাকবিতণ্ডা নেই, ভাস্কর্য নিয়েও নেই। ইন্দোনেশিয়াতেও বাকবিতণ্ডা নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমরা কেন এ ধরনের বিতর্কে জড়াব?’

অধ্যাপক সাদেকা হালিম আরও বলেন, ‘এ ধরনের বিতর্ক সমাজে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আমরা অবশ্যই শান্তি চাই। কিন্তু আমরা এ ধরনের বিতর্ক চাই না যে ভাস্কর্য বনাম মূর্তি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকেই যদি আমি স্বীকৃতি না দিই, তাহলে কিভাবে হবে! তাকে আমরা প্রতীকীভাবে দেখব। তার জন্যই আজকের বাংলাদেশ। আমার মনে হয় তার প্রতি সবারই শ্রদ্ধা রাখা উচিত।’

অনুষ্ঠানে অবশ্য মওলানা আতাউর রহমান বলেন, মূর্তি ও ভাস্কর্য একই জিনিস। ভাস্কর্যস্থাপন ইসলামবিরোধী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে হলে তার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। মওলানা আতাউর বলেন, বঙ্গবন্ধুর নামে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদরাসা স্থাপন করা হোক। তার নামে প্রয়োজনে মসজিদ-মন্দিরও স্থাপন করা হোক, কিন্তু মূর্তি নয়।

টপ নিউজ ড. সাদেকা হালিম বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট ভাস্কর্য মূর্তি রুহিন হোসেন প্রিন্স সারাবাংলা ফোকাস হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর