Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অভিযানের তথ্য পেয়ে বিদেশ পালাতে চেয়েছিল গোল্ডেন মনির


২২ নভেম্বর ২০২০ ০০:১৫

ঢাকা: গোল্ডেন মনির। এক সময় যাকে কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান মো. মনির হিসেবে চিনতো সবাই। সেই সেলসম্যানই সময়ের পরিবর্তনে হয়ে গেলেন গোল্ডেন মনির। মাসিক ৫০ টাকা বেতনে চাকরি করা মনির এখন হাজার কোটি টাকার অধিক সম্পত্তির মালিক। কোনো আলাদিনের চেরাগের গুণে নয়, মনির এসব অর্থ-ভৈববের মালিক হয়েছেন অবৈধ পথে স্বর্ণ ব্যবসা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি দখল করে। টাকার দাপটে সব সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে থাকা মনির অভিযানের খবর পেয়ে পালাতে চেয়েছিল। টাকা দিয়ে সে তার বিরুদ্ধে অভিযানের তথ্য সংগ্রহ করতো। আর সেই তথ্যানুযায়ী সময় মতো সটকে পড়তো। এবার সে পালাতে চেয়েছিল দুবাই। কিন্তু তার আগেই শনিবার (২১ শনিবার) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় গোল্ডেন মনির।

বিজ্ঞাপন

কাপড়ের দোকানের সাধারণ কর্মচারী মনির থেকে গোল্ডেন মনির হয়ে ওঠার গল্প খুঁজতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সময় লেগেছে প্রায় দেড় বছর। এ দীর্ঘ সময়ের অনুসন্ধানে তার উত্থানের চিত্র দেখে রীতিমতো অবাকও হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, ওয়ান ইলেভেনের সময়ও সে টাকার জোরে পার পেয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে। এমনকি দুদকও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অথচ এই মনিরের স্থাবর-অস্থাবর অধিকাংশ সম্পত্তি-ই অবৈধভাবে উপার্জিত।

বিজ্ঞাপন

গোল্ডেন মনির টাকার দাপটে সবসময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতো। কখনও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতো, আবার কখনও টাকা দিয়ে গোপন তথ্য পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান বা গ্রেফতারের সময় সটকে পরতো মনির। ঠিক একইভাবে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করবে এমন তথ্য পেয়ে যায় মনির। তাই দ্রুত দেশত্যাগ করতে ভিসা-বিমানের টিকিট সবই প্রস্তুত করেছিল সে। কিন্তু তার দেশ ছাড়ার তথ্য জেনে যায় গোয়েন্দা সংস্থা। যেকারণে সকাল দশটায় বিমানে ওড়ার আগেই মনিরের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায় র‍্যাব। আর এতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গোল্ডেন মনির।

শনিবার (২১ নভেম্বর) টানা ১১ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। অভিযানে তার বিলাসবহুল বাড়িতে দুটি ছয় কোটি দামের গাড়ি পাওয়া গেলেও সেসবের ছিল না কোনো বৈধ কাগজপত্র। সেইসঙ্গে ছয়শ ভরি অর্থাৎ আট কেজি স্বর্ণ, প্রায় নয় লাখ টাকার ১০টি দেশের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি নগদ এক কোটি নয় লাখ টাকা, অস্ত্র, গুলি ও বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। এসবের কোনোটিরই ছিল না অনুমোদন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বেশকয়েকটি মামলা হয়। সেইসঙ্গে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকেও মামলা হয়েছিল। সেসব মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্ক আমরা কিছু জানি না। আমরা একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছি। অভিযানে তার বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণ, অস্ত্র ও মাদকসহ দুটি বিলাসবহুল অনুমোদনহীন গাড়ি পেয়েছি। তার অটোকার শোরুমেও তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।’

তবে নির্ভরযোগ্য এক গোয়েন্দা সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, ১৯৯৩ সালের দিকে গোল্ডেন মনির গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো। সেখানে সে ৫০ টাকা মাসিক বেতন এবং তিনবেলা খাবারের শর্তে কাজ করেছে। ওই দোকানে মনির প্রায় ৫ বছর কাজ করে। এরপর মৌচাক এলাকার একটি ক্রোকারিজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ওই ব্যবসার পাশাপাশি সে লাগেজ ব্যবসা শুরু করে। এই ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমাদানি করতো ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে। এখান থেকেই উত্থান ঘটে গোল্ডেন মনিরের। লাগেজ ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। এরপর ২০০০ সালের দিকে নিজেই শুরু করে স্বর্ণপাচার। সিঙ্গাপুর ও ভারত রুটেই ছিল তার স্বর্ণপাচার ও হুন্ডির ব্যবসা। আর এ ব্যবসায় থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে গোল্ডেন মনির রাজউক ও গণপূর্তের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভুয়া সিল-স্বাক্ষরের মাধ্যমে একাধিক ভূমি দখল করে। রাজধানীর বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে তার দুই শতাধিক প্লট রয়েছে। সেইসঙ্গে বর্তমানে তার এক হাজার ৫০ কোটির অধিক অর্থের হিসাব পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গোল্ডেন মনির অবৈধভাবে উপার্জিত টাকার জোরে সবখানেই লোকজন সেট করে রেখেছিল। যেকারণে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান বা গ্রেফতারের পরিকল্পনা করলেই সে টের পেয়ে যেত। সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে- এমন তথ্য সে জেনে যায়। এজন্য দ্রুত সে দুবাই চলে যেতে ভিসা-টিকিট প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু গোয়েন্দা সূত্র বিষয়টি টের পেয়েই তাকে গ্রেফতার করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি গোয়েন্দা সংস্থা গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামলেও প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতার প্রমাণ পেতে বেগ পেতে হয়েছিল। তাই আরও কিছুদিন তাকে পর্যবেক্ষণে রেখে অনুসন্ধান চালানোর কথা থাকলেও সে পালিয়ে যাবে টের পেয়েই রাতেই অভিযান চালায় র‍্যাব। যে কারণে শেষ পর্যন্ত সে আর পালাতে পারেনি।’

তবে দেশত্যাগের চেষ্টার অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে গোল্ডেন মনিরের ছেলে রাফি হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার বাবা প্রায় সময় দুবাইয়ে চিকিৎসা করতে যান। আজও চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ছিল তার।’ কিন্তু মনির কোন রোগের চিকিৎসার জন্য দুবাই যেত তা বলতে পারেনি ছেলে রাফি। উল্টো রাফির দাবি, তার বাবা নির্দোষ এবং স্বনামধন্য ব্যবসায়ী।

রাফি বলেন, ‘আমার বাবা নির্দোষ। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না। আমরা আইনগতভাবে সব মোকাবিলা করব। বাবার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে সব ভিত্তিহীন। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমরা কোর্টে যাব। সেখানেই প্রমাণ হবে বাবা দোষী কি-না। সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

তবে র‍্যাব বলছে, গোল্ডেন মনিরের বড়ধরনের কোনো রোগ আছে বলে র‍্যাব এখনও জানতে পারেনি। এমনকি প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিতও হয়েছেন যে, রোগের জন্য বিদেশে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন নেই।

অভিযান গোল্ডেন মনির পালাতে বিদেশ র‍্যাব